দিনে দিনে কাজের চাপে হাঁপিয়ে ওঠা বাঙালিদের বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা লেগেই রয়েছে। প্রায়ই উইকেন্ডে বেরিয়ে পড়া বা ছোট ছুটি জমিয়ে পরিবার কিংবা বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে দু’দণ্ড সময়ে টিয়ে আসা মানুষের সংখ্যা এখন কম নয়। তাঁদের জন্যই রইল পশ্চিমবঙ্গের আনাচকানাচে লুকিয়ে থাকা খান দশেক অফবিট জায়গা যা সপ্তাহান্তের ছুটি কাটানোর জন্য আদর্শ। খুব বেশি দূরে যেতেও হবে না। চলুন দেখে নেওয়া যাক এমন দশটি জায়গা।
কলকাতা থেকে প্রায় ২৮০ কিলোমিটার দূরে বাঁকুড়া জেলার ঝিলিমিলি ফরেস্ট। হাওড়া স্টেশন থেকে খড়্গপুর, ঝাড়গ্রাম, চাকুলিয়া হয়ে ঘাটশিলা স্টেশনে নেমে শালে ঘেরা আমডুবির ঘন জঙ্গল পেরিয়ে পৌঁছতে হয় এখানে। ঝিলিমিলির ঘন জঙ্গলে রোমহর্ষক পরিবেশে ছুটি কাটানোর সেরা ঠিকানা স্থানীয় রানিবাঁধ পঞ্চায়েত সমিতির রিমিল ইকো ট্যুরিজম লজ। চোখ জুড়িয়ে যাওয়া ট্রি-হাউস এই লজের বিশেষত্ব। এছাড়াও রয়েছে ছোট ছোট কটেজ। বসন্তকালে, বিশেষ করে দোলের সময় ঝিলিমিলি ফরেস্ট যাওয়ার পক্ষে আদর্শ। রুক্ষ মাটির উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া পিচরাস্তার দুপাশে টকটকে লাল পলাশের সমাহার জঙ্গলের গোটা পরিবেশকে আরও মোহময়ী করে তুলবে, সন্দেহ নেই।
পশ্চিমবঙ্গের গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের কথা কখনও শুনেছেন? বিশ্বাস না হলে ঘুরে আসুন গনগনি। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার গনগনি পর্যটকদের জন্য সেরা জায়গাগুলির একটি। শিলাবতী নদী তার যাত্রাপথে গনগনিতে একটি সরু অথচ খাড়া এবং গভীর গিরিখাতের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে। এই কারণেই ‘পশ্চিমবঙ্গের গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন’ হিসেবে গনগনির আত্মপ্রকাশ। সাঁতরাগাছি থেকে ভোরবেলা রূপসী বাংলা বা আরণ্যক এক্সপ্রেস ধরে গড়বেতা স্টেশনে নেমে টোটোয় চেপে হুমগড়-গড়বেতা রুট ধরে শাল, সেগুন, আকাশবনি, মহুয়ার বন ও কাজুবাদামের বিস্তীর্ণ ক্ষেত পেরিয়ে অনায়াসেই একদিনের ট্রিপে ঘুরে আসা যায় গনগনি। পথে পড়বে আমলাগোড়া ফরেস্ট রেঞ্জ। কপাল ভাল থাকলে একপাল হাতির রাস্তা পেরোনোর দৃশ্য নজরে পড়তে পারে। ফেরিক বালিপাথরে তৈরি রুক্ষ উঁচুনিচু টিলা, গভীর গিরিখাত এখানকার বৈশিষ্ট্য। জনশ্রুতি, এই গনগনিতেই ভীম আর বকরাক্ষসের তুমুল যুদ্ধ হয়েছিল।
আদিগন্ত ফুলের বাগান দেখে মন জুড়িয়ে যেতে বাধ্য। শীতকালে এরকমই বিস্তীর্ণ ফুলের বাগানের দেখা পাওয়া যায় পূর্ব মেদিনীপুরের ক্ষীরাইয়ে। দোকান্দা গ্রামের কাছে শিলাবতী নদীর ধারে ক্ষীরাই একটা মনোরম জায়গা। হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেন ধরে পাঁশকুড়ায় নেমে দিব্যি চলে যাওয়া যায় ক্ষীরাইয়ে। ক্ষীরাই ফুলের খেতের জন্যই বিখ্যাত। এখানে মারিগোল্ড, অ্যাস্টার্স, হুইট উইলিয়াম, লাল গোলাপ, চন্দ্রমল্লিকা এবং আরও বিভিন্ন ধরনের ফুলের চাষ করা হয়। ক্ষীরাই ও পাঁশকুড়ার মধ্যে এরকম প্রচুর চোখ জুড়িয়ে যাওয়া ফুলের ক্ষেত দেখা যায়।
১৭৬৬ সালে তৈরি হুগলির ইটাচুনা রাজবাড়ি বাংলার পর্যটন মানচিত্রে একটি অফবিট জায়গা। ইতিহাসপ্রসিদ্ধ স্থান হিসেবে ইটাচুনা রাজবাড়ির বেশ নামডাক। হাওড়া-বর্ধমান লোকাল ধরে খন্ন্যান স্টেশনে নেমে টোটো ধরে মাত্র ১০ মিনিটে পৌঁছে যাওয়া যায় ইটাচুনা রাজবাড়ি। এর নাটমহল মূল প্রবেশদ্বার। গোটা রাজবাড়ি লাল রঙের, শুধু থামগুলোই সাদা। রাজবাড়ির অন্দরমহলে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। রয়েছে ৬০টি ভিনটেজ রুম। বাড়ির বৈঠকখানায় টাঙানো রয়েছে ব্রিটিশ আমলের বহু ছবি। ‘রাজমহল’, ‘লুটেরা’ সহ বেশ কিছু নামী ছবির শ্যুটিং হয়েছে ইটাচুনা রাজবাড়িতে। এখানে বেলা বারোটায় চেক ইন করে পরদিন সকাল দশটায় চেক আউট করা হয়।
বামনি ফলস পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ের একটি আকর্ষণীয় স্থান। ফলস অবধি পৌঁছতে গেলে পাহাড়ের কোলে ৭৫০টি সিঁড়ি ভেঙে নীচে নামতে হয়। সিঁড়ির দুপাশে রয়েছে ঘন ঝোপঝাড়। ফলসে নামার রাস্তা যথেষ্ট অ্যাডভেঞ্চারাস।
বিদ্যাধরী নদীর তীরে বেড়াচাঁপায় অবস্থিত ‘বাংলার হরপ্পা’ চন্দ্রকেতূগড় পশ্চিমবঙ্গের প্রত্নক্ষেত্রগুলির অন্যতম। ভারতের পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ (Archaeological Survey of India) একে ‘মনুমেন্ট অফ ন্যাশনাল ইম্পর্টেন্স’ হিসেবে গণ্য করেছে। প্রাচীন গ্রীস ও রোমের বিভিন্ন বিবরণে এই এলাকার উল্লেখ পাওয়া যায়। শুঙ্গ-কান্ব যুগে চন্দ্রকেতূগড় প্রসিদ্ধ নগর ও বন্দর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। মাটির তৈরি টেরাকোটার পাত্র চন্দ্রকেতূগড়ের অন্যতম আকর্ষণ।
দার্জিলিঙের অদূরে পাহাড়ের কোলে ছোট্ট গ্রাম চটকপুর। চটকপুরের উচ্চতা প্রায় ৭৫০০ ফিট। রোডোডেন্ড্রন, পাইন ও অন্যান্য নানা গাছে ঘেরা চটকপুরে জনবসতি প্রায় নেই বললেই চলে। কাছেপিঠে জঙ্গলে ভালুক, হিমালয়ান বুলবুল, ব্লু ম্যাগপাই দেখা যায়। আর আকাশ পরিষ্কার থাকলে মেঘের আড়াল থেকে উঁকি দেয় শ্বেতশুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘা। শিলিগুড়ি স্টেশন থেকে চটকপুরের দূরত্ব ৭৫ কিলোমিটার। বর্ষাকাল ছাড়া বছরের অন্য যে কোনও সময়ে আসা যেতে পারে। এখানে থাকার সেরা ঠিকানা, পশ্চিমবঙ্গ বন উন্নয়ন নিগমের টুরিস্ট লজ।
নিউ জলপাইগুড়ি জংশনে নেমে চলে যেতে পারেন কালিম্পং জেলার দোবান ও কান্নান ভ্যালিতে। স্টেশনে নেমে গ্যাংটকগামী শেয়ার ট্যাক্সি চড়ে চলে যান রংপো। রংপো থেকে রোরাথাং পাস হয়ে পৌঁছে যান গন্তব্যে। আগাম জানানো থাকলে অবশ্য একমাত্র থাকার জায়গা কান্নন ভ্যালি হোমস্টে থেকেই পাঠিয়ে দেওয়া হবে গাড়ি। নির্জন, নিরিবিলি পার্বত্য পথ এই অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য।
লেপচাজগৎ থেকে দার্জিলিঙের দূরত্ব মাত্র ১৯ কিলোমিটার। এনজেপি স্টেশন থেকে শেয়ার ক্যাবে মিরিক বা শুকিয়াপোখরি হয়ে পৌঁছানো যায়। মনোরম পাহাড়ের শোভা লেপচাজগতের দ্রষ্টব্য। এখান থেকে রাতের দার্জিলিং শহর দেখা যায়। প্রধান আকর্ষণ পাহাড়ের কোলে সূর্যোদয়, আর কপাল ভালো থাকলে কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ শোভা। পাখরিন, কাঞ্চনজঙ্ঘা ও গ্রিন ভ্যালি হোমস্টে থাক্র জন্য ভালো কয়েকটি জায়গা। এছাড়াও আছে পশ্চিমবঙ্গ বন উন্নয়ন নিগমের টুরিস্ট লজ।
তাকদা হিমালয়ের কোলে ছোট্ট একটা গ্রাম। শিয়ালদা থেকে ট্রেন ধরে এনজেপিতে নেমে ট্যাক্সি ধরে চলে যাওয়া যায় তাকদা। পাকদণ্ডী পথে পড়বে উত্তাল খরস্রোতা তিস্তা নদী, বিস্তীর্ণ চা বাগান ও ছোট ছোট ঝরনা। তাকদা থেকে চলে যেতে পারেন তিনচুলে মনাস্ট্রি। এছাড়াও গুম্ভাধারা ভিউপয়েন্ট থেকে দেখতে পারেন কাঞ্চনজঙ্ঘাকে।