দারিদ্র্য বিমোচনে ইসলামে জাকাত ব্যবস্থার গুরুত্ব অপরিসীম


ধর্ম ডেস্ক: , আপডেট করা হয়েছে : 08-04-2023

দারিদ্র্য বিমোচনে ইসলামে জাকাত ব্যবস্থার গুরুত্ব অপরিসীম

ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধান। মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় জীবনের সকল কর্মে সঠিক দিক নির্দেশনা রয়েছে ইসলামে। মানুষের মৌলিক অধিকার, সামাজিক সুবিচার এবং মানব সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠার যেমন ব্যবস্থা করেছে ইসলাম তেমনি ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দূর করে জাকাত ব্যবস্থার মাধ্যমে ভারসাম্যমূলক অর্থনীতি উপহার দিয়েছে।

বিশ্বজুরে প্রতিনিয়ত দারিদ্র্যের থাবা বিস্তার হচ্ছে। ক্ষুধা ও দারিদ্র্য বিশ্বমানবতার জন্য চরম এক অভিশাপ। তাই ধনী ও দরিদ্রের অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যে ইসলাম কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য আর্থিক সাহায্যের বিধান রেখেছে। সম্পদ যেন শুধু বিত্তবানদের মধ্যেই পুঞ্জীভূত না থাকে সে জন্য এতে দরিদ্রের একটা নির্দিষ্ট প্রাপ্য অধিকার নিশ্চিত করে দেওয়া হয়েছে। একটি সুখী সুন্দর ও উন্নত সামাজিক পরিবেশ গঠনে ধনাঢ্য মুসলমানদের অবশ্যই তাদের নিসাব পরিমাণ সম্পদের একটি নির্ধারিত অংশ দরিদ্র ও অভাবগ্রস্ত ব্যক্তিদের দুর্দশা মোচনের জন্য ব্যয় করতে হবে। ফলে অসহায় ও দুস্থ মানবতার কল্যাণই হবে না বরং সমাজে আয়বণ্টনের ক্ষেত্রেও বৈষম্য হ্রাস পাবে। পবিত্র কোরআনে ধনসম্পদ বণ্টনের মূলনীতি সম্পর্কে ঘোষণা হয়েছে-

لَا یَکُوۡنَ دُوۡلَۃًۢ بَیۡنَ الۡاَغۡنِیَآءِ مِنۡکُمۡ

‘যাতে তোমাদের মধ্যে যারা বিত্তবান কেবল তাদের মধ্যেই ঐশ্বর্য আবর্তন না করে। (সুরা আল-হাশর: আয়াত ৭)

দারিদ্র্য বিমোচনে ইসলাম অর্থনৈতিক বিষয়কে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করেছে। অর্থ-বিত্তের মাধ্যমেই সমাজে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধান বৃদ্ধি পায়। ইসলামি বিধানে সমাজের দরিদ্র জনসাধারণের আর্থিক প্রয়োজনের ব্যাপকতার প্রতি লক্ষ রেখে তৃতীয় হিজরিতে ধনীদের ওপর জাকাত ফরজ করা হয়েছে। সমাজে ধনসম্পদের আবর্তন ও বিস্তার সাধন এবং দারিদ্র্য দূরীকরণের মহান উদ্দেশ্যেই জাকাত ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়েছে। দারিদ্র্য বিমোচন ও বেকার সমস্যা সমাধান জাকাতভিত্তিক অর্থব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য। জাকাত বণ্টনের খাতগুলো এ লক্ষ্যেই নিবেদিত। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে-

اِنَّمَا الصَّدَقٰتُ لِلۡفُقَرَآءِ وَ الۡمَسٰکِیۡنِ وَ الۡعٰمِلِیۡنَ عَلَیۡهَا وَ الۡمُؤَلَّفَۃِ قُلُوۡبُهُمۡ وَ فِی الرِّقَابِ وَ الۡغٰرِمِیۡنَ وَ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ وَ ابۡنِ السَّبِیۡلِ ؕ فَرِیۡضَۃً مِّنَ اللّٰهِ ؕ وَ اللّٰهُ عَلِیۡمٌ حَکِیۡمٌ

‘সাদকা বা জাকাত তো কেবল নিঃস্ব, অভাবগ্রস্ত, জাকাত আদায়কারী কর্মচারীদের জন্য যাদের চিত্তাকর্ষণ করা হয় তাদের জন্য, দাসমুক্তির জন্য ঋণ ভারাক্রান্ত ব্যক্তিদের আল্লাহর পথে সংগ্রামকারী ও মুসাফিরদের জন্য ; এটা আল্লাহর বিধান। (সুরা আত-তওবা: আয়াত ৬০)

বর্ণিত হয়েছে, কোনো মানুষের পা কেয়ামতের দিন পাঁচটি প্রশ্নের সদুত্তর দেওযা ছাড়া এক বিন্দুও জায়গা থেকে নরাতে পারবে না-

১. জীবন কোন পথে ব্যয় করেছো

২. যৌবন কোন পথে ব্যয় করেছো

৩. আয় কোন পথে করেছো

৪. ব্যয় কোন পথে করেছো এবং

৫. ইসলাম সম্পর্কে যে জ্ঞান অর্জন করেছো তা কতটা বাস্তবায়ন করেছো।

এখানে দেখা যাচ্ছে যে পাঁচটি প্রশ্নের মধ্যে দু’টি প্রশ্নই অর্থনীতির উপর নির্ধারণ করা হয়েছে। কেউ যেন অবৈধভাবে সম্পদ সংগ্রহ করে ধনের পাহাড় গড়তে না পারে সে জন্য উপার্জিত অর্থের হিসাব গ্রহণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

আবার কেউ যেন অর্জিত অর্থ অবৈধ পথে ব্যয় করতে না পারে তার জন্য ব্যয় হিসাব গ্রহণের ব্যবস্থা রয়েছে। সম্পদের আয়-ব্যয় হিসাব গ্রহণের ব্যবস্থা করে যেমন এক্ষেত্রে অন্যায় পথ থেকে দূরে থাকার সতর্ক করা হয়েছে তেমনি ধনীরা অর্থ উপার্জন করে পুঁজিপতি আর গরীবরা আরও গরীব হওয়া থেকে রক্ষার জন্য ধনী-গরীবের মধ্যে অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা ও বৈষম্য দূরীকরণের জন্য ইসলাম জাকাতের ব্যবস্থা করেছে।

দারিদ্র্য দূরীকরণে জাকাতের মতো আর কোনো অর্থব্যবস্থাই সমাজের সার্বিক হিত সাধন করতে পারে না। ইসলামি সমাজে তাই জাকাত একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ বণ্টনব্যবস্থা। জাকাত ইসলামের পঞ্চ¯তম্ভের অন্যতম ফরজ আর্থিক ইবাদত। জাকাত হতদরিদ্র, অভাবী ও অক্ষম জনগোষ্ঠীকে সামাজিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা প্রদান করে।

নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জীবনব্যাপী দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য সংগ্রাম করে গেছেন। দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত আরবদের তিনি অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী জাতি হিসেবে গড়ে তুলেছেন। তাঁর প্রবর্তিত অর্থব্যবস্থার মূল লক্ষ্য ছিল সমাজে সুষম ভারসাম্যপূর্ণ ও কার্যকরী জাকাতব্যবস্থা প্রচলনের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন।

জাকাত অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। তাই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, জাকাত ইসলামের সেতু। ধনী লোকেরা তাদের ধনসম্পদের ৪০ ভাগের এক অংশ অসহায় দরিদ্রদের মধ্যে জাকাত বিতরণ করলে গরিব লোকেরা দারিদ্র্যের নিষ্ঠুর কশাঘাত থেকে মুক্তি পায়।

ইসলামি বিধান অনুসারে জাকাত প্রদানের ফলে সমাজের ঋণগ্রস্ত গরিব-দুঃখী,অনাথ, বিধবা, বৃদ্ধ ও অক্ষম ব্যক্তিরা মৌলিক চাহিদা পূরণের মাধ্যমে অভাব মোচন করতে পারে। জাকাতের অর্থ অভাবী মানুষের হাতে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বণ্টিত হয়ে তাদের ক্ষুধা ও দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়ক হয়। ধনী লোকেরা যদি ঠিকমতো জাকাত আদায় করে, তাহলে সমাজে কোনো অন্নহীন, বস্ত্রহীন, আশ্রয়হীন, শিক্ষাহীন দরিদ্র লোক থাকতে পারে না।

জাকাতের সুষ্ঠু আদায় ও সুষম বণ্টনের মাধ্যমেই মুসলিম সমাজের দারিদ্র্য দূরীকরণ সম্ভব। যেমনভাবে পবিত্র কোরআনে ঘোষিত হয়েছে-

وَ فِیۡۤ اَمۡوَالِهِمۡ حَقٌّ لِّلسَّآئِلِ وَ الۡمَحۡرُوۡمِ

তাদের ধনসম্পদে রয়েছে অভাবগ্রস্ত ও বঞ্চিতের হক। (সুরা আল-জারিআত: আয়াত ১৯)

জাকাতের মাধ্যমে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখা হয়। ইসলামে সম্পদ বণ্টনব্যবস্থায় ধনীরা তাদের সম্পদের কিছু অংশ জাকাত দিলে গরিবদের সম্পদ কিছুটা বেড়ে যায় এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর হয়।

জাকাতভিত্তিক অর্থব্যবস্থা নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ মদিনা রাষ্ট্র খোলাফায়ে রাশেদিনের শাসনামলে অর্থনৈতিক বৈষম্য ও দারিদ্র্য বিমোচন করে মুসলিম উম্মাহকে সমকালীন বিশ্বে একটি সমৃদ্ধ ও উন্নত জাতিতে পরিণত করেছিল।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সব সময় আল্লাহর কাছে দারিদ্র্য থেকে মুক্তির প্রার্থনা করতেন এবং বরকতের জন্য দোয়া করতেন। তিনি মানুষকে উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের ওপর সাদকা (জাকাত) অপরিহার্য করেছেন যা তাদের ধনীদের কাছ থেকে আদায় করে দরিদ্রদের মধ্যে বণ্টন করা হবে।

মুসলিম সমাজের গরীব, অসহায়, এতিম মানুষগুলো অর্ধাহারে, অনাহারে, গৃহহীন, বস্ত্রহীন হয়ে অসহনীয় দুঃখ যাতনার মধ্যে জীবন যাপন করছে। বাস্তুহারা জীবন যাপনে বাধ্য হয়ে এসব দুঃখী মানুষ ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর প্রহর গুনছে। ইসলামের জাকাত ব্যবস্থা সঠিকভাবে কার্যকর করে এসব অসহায় মানুষের পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা সম্ভব।

ইসলামে জাকাত ব্যবস্থার গুরুত্ব অপরিসীম। আল্লাহ তাআলার হুকুম মেনে চলার নামই ইবাদত। প্রাথমিকভাবে ইবাদতকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমত: দৈহিক ইবাদত ও দ্বিতীয়ত: আর্থিক ইবাদত। জাকাত হল আর্থিক ইবাদত। আর্থিক ইবাদতের মধ্যে জাকাতের গুরুত্ব সর্বাধিক। নামাজের মতই এটি ফরজ। কোরআন ও হাদিসে জাকাত প্রদানের জন্য তাগিদ দেওয়া হয়েছে। মানব সমাজের বিরাট অংশ দরিদ্র। এই দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে ইসলামের জাকাত ব্যবস্থা একটি কার্যকর পন্থা।

শুধু আমাদের দেশেই নয় গোটা মুসলিম জাহানের মুসলমানের বিরাট অংশ আজ দারিদ্রতার শিকার। আর এই দারিদ্রতা বিমোচনের ক্ষেত্রে জাকাত ব্যবস্থার অবদান অনস্বীকার্য। বাধ্যতামূলকভাবে নির্ধারিত নিয়মে জাকাত আদায়ের ব্যবস্থা করা হলে দারিদ্রতার অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

ইসলাম জাকাতভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থার মাধ্যমে সমাজকে দারিদ্র্য থেকে উদ্ধার করতে চায়। কিন্তু দেশে যেভাবে জাকাত আদায় ও বণ্টন করা হয় এতে জাকাতগ্রহীতা স্থায়ীভাবে পুনর্বাসনের উদ্দেশ্যে কোনো ধরনের পেশা বা কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারে না।

দেশের আদায়যোগ্য জাকাতের পরিমাণ ৫০০ কোটি টাকারও অধিক হতে পারে ; যা দ্বারা প্রতিবছর দুই লাখ লোকের পুনর্বাসন সম্ভব। পরিকল্পিতভাবে কাজ করলে এভাবে ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে সম্পূর্ণরূপে দেশের দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব।

তাই সমবেত প্রচেষ্টার মাধ্যমে সুপরিকল্পিতভাবে ইসলামের বিধান অনুযায়ী জাকাত আদায় ও তার যথাযথ বণ্টনের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণ ও মানুষের স্থায়ী কল্যাণের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা একান্ত প্রয়োজন।

পরিশেষে উপরের আলোচনা থেকে এটা সুস্পষ্ট যে আল্লাহ তাআলা নিসাব পরিমাণ ধন-সম্পদের মালিকদের উপর জাকাত ফরজ করেছেন এবং নির্ধারিত হারে জাকাত প্রদান করা অপরিহার্য। আর জাকাত আদায় না করাটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। জাকাতের অর্থ দরিদ্র, দুঃস্থ, ফকির, মিসকিন, অসহায় মানুষের প্রাপ্য। আর এসব মানুষের দারিদ্রতা বিমোচন ও পুনর্বাসনে ইসলামের জাকাত ব্যবস্থার যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে।

আসুন, আমরা ব্যক্তিগত সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে জাকাত ভিত্তিক অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করি আমরা মানবতার কল্যাণ সাধন করে শান্তির সমাজ কায়েম করি আমরা সবাই মিলে পরকালে জান্নাতের পথে এগিয়ে যাই। আল্লাহপাক আমাদের সবাইকে সঠিক দায়িত্ব পালনে তাওফিক দিন। আমিন।



লেখক : ফখরুল ইসলাম নোমানী, ইসলামি চিন্তক ও গবেষক।


Publisher & Editor :Md. Abu Hena Mostafa Zaman

Mobile No: 01971- 007766; 01711-954647

Head office: 152- Aktroy more ( kazla)-6204  Thana : Motihar,Rajshahi
Email : [email protected], [email protected]