জনসংখ্যায় পৃথিবীর বৃহত্তম মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম ইসলামী সংগঠন মুহাম্মাদিয়া। ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে শুরু করে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে মুহাম্মাদিয়ার ভূমিকা অনবদ্য। ইন্দোনেশিয়ার দারিদ্র্য বিমোচন, টেকসই উন্নয়ন, জনশক্তির দক্ষতা বৃদ্ধি, সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নানামুখী কার্যক্রম রয়েছে সংগঠনটির। শতবর্ষী সংগঠনের সাফল্যের তালিকাও বেশ দীর্ঘ।
মুহাম্মাদিয়ার জন্মকথা : মুহাম্মাদিয়া ইন্দোনেশিয়ার প্রাচীনতম সংস্কারবাদী ইসলামী সংগঠন। ১৯১২ সালে হাজি আহমদ দাহলান জোগজাকার্তায় মুহাম্মাদিয়ার গোড়াপত্তন করেন। মুহাম্মাদিয়া কুসংস্কারমুক্ত একটি আধুনিক মুসলিম সমাজ প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকারবদ্ধ। ইন্দোনেশিয়ার তিন কোটি মানুষ এই সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে ধারণা করা হয়। ১৯২৩ সাল পর্যন্ত আহমদ দাহলান মুহাম্মাদিয়ার নেতৃত্ব দেন। ১৯২৫ সালে আবদুল করিম আমরুল্লাহ সংগঠনটির নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৩৮ সালের ভেতর ইন্দোনেশিয়ার বেশির ভাগ অঞ্চলে মুহাম্মাদিয়ার কার্যক্রম ছড়িয়ে পড়ে। আবদুল করিম আমরুল্লাহই নারীদের জন্য ‘আয়েশা’ নামে পৃথক শাখা প্রতিষ্ঠা করেন। পর্যায়ক্রমে সংগঠনের কার্যক্রমের পরিধি বিস্তৃতি লাভ করতে থাকে। (প্রবন্ধ : দ্য হিস্টোরি অব দ্য গ্রোথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অব দ্য বিগ ইসলামিক অরগানাইজেশনস ইন ইন্দোনেশিয়া)
সামাজিক সুরক্ষায় অবদান
ইন্দোনেশিয়ার সামাজিক সুরক্ষায় মুহাম্মাদিয়ার বহুমুখী অবদান আছে। বিষয়টি তুলে ধরেছেন গবেষক এম আহমদ, আরবি সোয়েমান্ত, টিকে দ্রাজাট ও ডাব্লিউ ইদি। তাঁরা তাঁদের ‘দ্য রোল অব মুহাম্মাদিয়া ইন সাস্টেইনেভল ডেভেলপমেন্ট’ শীর্ষক প্রবন্ধে আর্থিক ও সামাজিক উন্নয়নে মুহাম্মাদিয়ার নানামুখী ইতিবাচক ভূমিকা বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁদের তথ্যমতে ইন্দোনেশিয়ার সামাজিক সুরক্ষায় মুহাম্মাদিয়া মূলত তিনটি খাতে কাজ করছে : ক. শিক্ষা, খ. স্বাস্থ্য, গ. দারিদ্র্য বিমোচন। তাঁরা লিখেছেন, ‘বহু মানুষের জীবনস্পর্শকারী দাতব্য ব্যবসা প্রচলনের মাধ্যমে মুহাম্মাদিয়া আন্দোলন ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় জীবনে অবদান রেখে চলেছে। ২০১৮ সালের তথ্যানুসারে সংগঠনটি দুই হাজার ২২৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, এক হাজার ১১১টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, এক হাজার ২৯১টি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১৭১টি বিশ্ববিদ্যালয়, দুই হাজার ১১৯টি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ৮২টি পঙ্গু ও বিকলাঙ্গ পুনর্বাসন কেন্দ্র, ৩১৮টি সোশ্যাল হোম প্রতিষ্ঠা করেছে।
এ ছাড়া সংগঠনটি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য ৭১টি বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ছোট-বড় ছয় হাজার ১১৮টি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেছে। সংগঠনের মালিকানায় আছে দুই কোটি ৯ লাখ ৪৫ হাজার ৫০৪ বর্গ মিটার ভূমি। (প্রবন্ধ : রোল অব মুহাম্মাদিয়া ইন সোশ্যাল ইম্পাওয়ারমেন্ট)
বহুমুখী লক্ষ্য ও কার্যক্রম
ইন্দোনেশিয়ার সামাজিক সুরক্ষা মুহাম্মাদিয়া যেসব উদ্দেশ্যে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে তা নিম্নরূপ।
১. ইসলামী বিশ্বাস ও মূল্যবোধের বিকাশ ও মুসলমানের জীবনে ইসলামী বিধান বাস্তবায়ন।
২. ইসলামী শিক্ষার প্রচার ও প্রসার।
৩. ঐচ্ছিক ও আবশ্যক দান-অনুদানের মাধ্যমে সামাজিক ভারসাম্য ও সুরক্ষা নিশ্চিতি করা।
৪. কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে জনসংখ্যাকে সম্পদে পরিণত করা এবং কর্মশক্তিসম্পন্ন মানুষের কর্মদক্ষতা ও মান বৃদ্ধি করা।
৫. শিক্ষা-সংস্কৃতির বিকাশ তথা বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, শিল্প ও গবেষণার মান ও পরিমাণ বৃদ্ধি।
৬. অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উদ্যোক্তাদের সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন।
৭. স্বাস্থ্যসেবার বিস্তারের মাধ্যমে সুস্থ প্রজন্ম গড়ে তোলা।
৮. টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে পরিবেশবান্ধব অর্থনীতির বিকাশ ঘটানো এবং প্রাকৃতিক সম্পদের ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করা।
৯. পারস্পরিক যোগাযোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সমাজ গঠন করা।
১০. কর্মীদের মানোন্নয়নের মাধ্যমে সংগঠনকে শক্তিশালী করা। (প্রবন্ধ : রোল অব মুহাম্মাদিয়া ইন সোশ্যাল ইম্পাওয়ারমেন্ট)
সামাজিক সুরক্ষায় মুহাম্মাদিয়া মডেল
মুহাম্মাদিয়া তার উল্লিখিত লক্ষ্য অর্জনে নিম্নোক্ত কর্মপদ্ধতি অনুসরণ করে থাকে।
১. সাংগঠনিক সক্ষমতা অর্জন : মুহাম্মাদিয়া তাদের লক্ষ্য অর্জনে সর্বপ্রথম তাদের সাংগঠনিক সক্ষমতা অর্জন করে এবং নিয়মিত তা বৃদ্ধি করে চলছে। সংগঠনটি একাধিক শাখা সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছে। যেমন, ক. মজলিসে তাজরিহ ওয়াত তাজদিদ, খ. তাবলিগ কাউন্সিল, গ. প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা কাউন্সিল, ঘ. ক্যাডার এডুকেশন কাউন্সিল, ঙ. সোশ্যাল সার্ভিস কাউন্সিল, চ. ইকোনোমিক অ্যান্ড ইন্ট্রাপেনরশিপ, ছ. কমিউনিটি ইম্পাওয়ারমেন্ট কাউন্সিল, জ. পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কাউন্সিল, ঝ. লাইব্রেরি অ্যান্ড ইনফরমেশন কাউন্সিল, ঞ. ইনভাইরনমেন্ট কাউন্সিল, ট. ল’ অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস কাউন্সিল, ঠ. ওয়াকফ অ্যান্ড ম্যাটেরিয়াল কাউন্সিল।
২. যোগ্য নেতৃত্ব তৈরি : যোগ্য নেতৃত্ব তৈরির মাধ্যমে মুহাম্মাদিয়া সমাজ ও সংগঠনকে এগিয়ে নিচ্ছে। কর্মীদের আস্থা, ব্যক্তির যোগ্যতা, আত্মত্যাগের মানসিকতা ও সাংগঠনিক তৎপরতার ভিত্তিতে মুহাম্মাদিয়া তাদের নেতৃত্ব নির্বাচন করে থাকে।
৩. ধর্মীয় অনুপ্রেরণা তৈরি : ইন্দোনেশিয়া পৃথিবীর বৃহত্তম মুসলিম জনসংখ্যার দেশ। তাই সামাজিক সুরক্ষায় ধর্মীয় অনুপ্রেরণা গুরুত্বপূর্ণ। মুহাম্মাদিয়া আত্মশুদ্ধি, ধর্মীয় জীবনযাপন, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি মুসলমানের দায়বদ্ধতার কথা বলে থাকে। যা প্রকারান্তে তাদের কার্যক্রমকেই শক্তিশালী করে।
৪. সক্রিয় কর্মী দল গঠন : মুহাম্মাদিয়ার ধর্মীয়, সামাজিক ও অর্থনীতিক কর্মসূচি বাস্তবায়নে তার কর্মীরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে থাকে। মুহাম্মাদিয়ার কর্মীরা দলের জন্য একজন স্বেচ্ছাসেবীর মতোই কাজ করে থাকে।
৫. সম্পদের লাভজনক ব্যবহার : মুহাম্মাদিয়া অর্জিত সম্পদ দাতব্য খাতে পুরোপুরি ব্যয় না করে, লাভজনক সেবাসংস্থা গড়ে তুলেছে। যেমন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, ইসলামী মাইক্রোফিন্যান্স প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি। এতে সংগঠনটি তাদের সম্পদের পরিমাণ বৃদ্ধি ও তার পুনর্ব্যবহারের সুযোগ যেমন পাচ্ছে, তেমন সংগঠনেরও কার্যক্রম বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৬. জাকাতের আধুনিক ব্যবস্থাপনা : সামাজিক সুরক্ষায় মুহাম্মাদিয়ার ব্যাপক সাফল্যের পেছনে আছে জাকাতের আধুনিক ব্যবস্থাপনায় তার দক্ষতা। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে মুহাম্মাদিয়া জাকাতের অর্থ সংগ্রহ করে তা পরিকল্পিতভাবে ব্যয় করেছে। ফলে সংগঠনটি দারিদ্র্য বিমোচন, দাতব্যপরিসেবা বৃদ্ধি, সামাজিক সুরক্ষামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার সুযোগ পেয়েছে।
৭. সামাজিক পরিষেবা : মুহাম্মাদিয়ার কার্যক্রমগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মুহাম্মাদিয়ার প্রতিটি কার্যক্রমই সমাজসম্পৃক্ত ও গণমুখী। এর সুফল ও সুবিধা মূলত জনগণই লাভ করে থাকে। এটাও মুহাম্মাদিয়ার সাফল্যের অন্যতম রহস্য।
(প্রবন্ধ : দ্য রোল অব ইসলামিক এনজিও ইন দ্য সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার মুভমেন্ট)