‘চাঁদাবাজি’ ছেড়ে কর্মে ফিরছে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ


ইব্রাহীম হোসেন সম্রাট: , আপডেট করা হয়েছে : 23-02-2023

‘চাঁদাবাজি’ ছেড়ে কর্মে ফিরছে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ

রাজশাহীর কাটাখালী এলাকায় পথে পথে ঘুরে বেড়াতেন তৃতীয় লিঙ্গের হেনা। মানুষের কাছে হাত পেতেই মিটতো তার পেটের খুদা। এজন্য অনেকের হাতে মারও খেতে হয়েছে তাকে। এক সময় তিনি বুঝতে পারেন, নিজে কিছু করতে হবে। তাই অনেক কষ্টে জমানো টাকা দিয়ে ২০০২ সালে শুরু করেন ডিমের ব্যবসা।

২০১৪ সালে পলি নামে তৃতীয় লিঙ্গের আরেক সদস্যও মানুষের কাছে হাত পাতা ছেড়ে দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। তাদের দেখাদেখি মামুন হক জুঁই ও সবুজ হক আঁখিও শুরু করেন ব্যবসা। তাদের এখন নিজেদের দোকান আছে। কোনো কোনো দোকানে আছে কর্মচারীও।

হেনা, পলি, আঁখি আর জুঁইদের মতো রাজশাহীতে এখন অন্তত ৩৫ জন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ কর্মে ফিরেছেন। এক সময় এই তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যদের কাজই ছিল তাদের দলনেতার অধীনে বাড়িতে ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে চাঁদাবাজি করা। সেই চাঁদার টাকা দিনশেষে দলনেতার হাতে তুলে দেওয়ার পর তিনি খুশি মনে যা দিতেন তাই দিয়েই কোনোমতে চলছিল জীবন।

তবে এমন জীবন অভিশাপের, এ অনুভব থেকে সমাজে গ্রহণযোগ্য কর্মে আসতে চান তারা। ইচ্ছা হয় সমাজের সভ্য মানুষগুলোর মতো স্বাবলম্বী হয়ে বাঁচতে। এরপর ফিরে আসছেন অনেকেই। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন ও দিনের আলো হিজড়া সংঘের সহায়তায় তারা কর্মে ফিরছেন। সেইসঙ্গে অন্ধকারের পথ ছেড়ে তারা এখন ফিরছেন স্বাভাবিক জীবনে।

দিনের আলো হিজড়া সংঘের তথ্য মতে, রাজশাহী জেলায় তাদের আওতায় ৯০০ জন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ আছেন। তাদের সংগঠনের সদস্য ১১৯ জন। যাদের মধ্যে গত কয়েক বছরে কর্মে ফিরেছেন অন্তত ৩৫ জন। তাদের মধ্যে কেউ নিজে প্রতিষ্ঠান দিয়েছেন। আবার কেউ কেউ বিভিন্ন এনজিও বা অফিসের যোগ দিয়েছেন।

কর্মে ফেরা একজন হলেন সবুজ ইসলাম আঁখি। তিনি বলেন, আমি শুরু থেকেই হাত পেতে খেতে ভালো বাসতাম না। অনেক সময় আমাদের সমাজের সবাই বলেছে, আমাদের সঙ্গে এলে দিনে এক হাজার টাকা পাবি। আমি যাইনি। আমি বলেছি, আমার এক হাজার টাকার দরকার নেই। আমি খেয়ে পরে আর দশটা মানুষের মতো বাঁচতে চাই। এরপর আমি দোকান দিই। সেখানেই বিক্রি শুরু করি। এখন আমার নিজের আয়েই নিজে চলি।

ছয় বছর গুরুর কাছে থাকার পর কর্মে ফিরেছেন হানুফা। তিনি বলেন, আমি আগে ছয় বছর সিরাজগঞ্জে এক গুরুর কাছে থাকতাম। মানুষের কাছে টাকা তুলে সেই টাকা দিয়েই চলতাম। এরপর রাজশাহীতে এসে আমি টি-বাঁধ এলাকায় টাকা তুলতে শুরু করি। তবে কিছুদিন পর আমাকে ডিসি স্যারের সহায়তায় মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন থেকে ফুল কিনে দেয়। সেই ফুল বিক্রি করেই আমার আয় হতে শুরু করে।

হানুফা আরও বলেন, প্রথম যেদিন আমি ফুল নিয়ে সেখানে যাই সবাই আমাকে কাছে টেনে নিয়েছিল। আমার সব ফুল এক ঘণ্টাতেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। এমনকী যারা আমাকে টাকা দেওয়ার সময় মারতো, গালি দিতো তারাও সেদিন বেশি দাম দিয়ে ফুল কিনে নিয়েছে। এখন প্রতিদিন ফুল বিক্রি করে আমি যা আয় করি তাই দিয়েই আমার থাকা খাওয়া হয়ে যায়।

রাজশাহী রেলগেট এলাকায় পানের দোকান চালান মামুনুল হক জুঁই। তিনি বলেন, আমার দোকান ভালোই চলছে। তবে অনেকেই শুরুর দিকে মেনে নিতো না। এখন তারা বেশ ভালোভাবেই মেনে নিয়েছে। আমি তাদের কাছে মালামাল বিক্রি করি। তারাও কিনে নেয়। আগের জীবনের চেয়ে বর্তমান জীবন অনেক ভালো লাগছে। আগে অনেক কষ্টের জীবন ছিল। এখন আমি নিজেই টাকা আয় করি।

রাজশাহীর দিনের আলো হিজড়া সংঘের সভাপতি মোহনা বলেন, ২০০২ সাল থেকে আমরা কাজ করছি। ২০১৩ সালে আমাদের সরকার স্বীকৃতি দেয়। এরপর অনেকেই কর্মে ফিরতে শুরু করেছে। কিন্তু অনেকেই আমাদের কাজ দিতে চায় না। আমাদের মধ্যে দক্ষ কেউ নেই। আমাদের ট্রেনিং নেই।

তিনি বলেন, অনেকেই আগের পেশায় থাকতে চাচ্ছে। কারণ, সেখানে তাদের ভালো খাওয়া-দাওয়া হয়। কিন্তু যারা চাকরি দিতে চাচ্ছে তারা মাসে কেউ তিন হাজার, কেউ চার হাজার টাকা দিতে চায়। এ টাকায় তো চলা সম্ভব না। সরকার ঘোষণা দিয়েছে, যারা আমাদের কাজ দেবে তাদের ভ্যাট-ট্যাক্স দিতে হবে না। তারপরও আমাদের তেমন কাজে সাড়া পাওয়া যায় না।

মোহনা বলেন, জেন্ডার সমতা বলা হচ্ছে, কিন্তু আসলে এমনটি হয়নি। আমাদের না থাকতে দিচ্ছে পরিবার, না থাকতে দিচ্ছে সমাজ। এই মানুষগুলো কই যাবে? সবাই মিলে আমাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হলে তবেই আমরা আর বোঝা হয়ে থাকবো না। আমরা বোঝা থেকে সম্পদে পরিণত হবো এবং দেশের জন্য ভালো কিছু করবো।

রাজশাহী সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক হাসিনা মমতাজ বলেন, তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর মানুষ এখন অনেক বদলেছে। আগে তারা চাঁদাবাজি করতো। এখন অনেকেই চাকরি করছে। অনেকেই ব্যবসা করছে। সমাজসেবা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। আমরা তাদের অনেক অনুষ্ঠানে যাই, সেখানে অনুপ্রেরণামূলক কথাবার্তা বলি।

তিনি আরও বলেন, তারা কেউ ব্যবসা করার জন্য ঋণ চাইলে আমরা সে ক্ষেত্রেও সহযোগিতা দেবো। তবে এখনো কেউ এই সহযোগিতা চায়নি। কোনো বাড়িতে তৃতীয় লিঙ্গের শিশুর জন্ম হলে পরিবারের পাশে থাকা খুব দরকার। তাদের কিছু সমস্যা রয়েছে; কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তারা আর সব স্বাভাবিক মানুষের মতোই যোগ্য।


Publisher & Editor :Md. Abu Hena Mostafa Zaman

Mobile No: 01971- 007766; 01711-954647

Head office: 152- Aktroy more ( kazla)-6204  Thana : Motihar,Rajshahi
Email : [email protected], [email protected]