গর্ভধারণকালে মায়ের স্বাস্থ্য ও জীবনযাপনের ধরন শিশুর স্নায়ুবিকাশে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ন্ত্রকের কাজ করে। মা ও শিশুদের নিয়ে ফিনল্যান্ডের টুরকু বিশ্ববিদ্যালয় ও টুরকু বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে গর্ভবতী মায়ের ডায়াবেটিস, স্থূলতা ও খাদ্যাভ্যাস শিশুর দুই বছর বয়স পর্যন্ত স্নায়ুবিকাশে প্রভাব ফেলে।
গবেষণায় দেখা গেছে, গর্ভকালীন ডায়াবেটিস ও মায়ের শরীরের অধিক চর্বি শিশুর স্নায়ুবিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত করে। মা যদি নিয়মিত ভালো খাবার খায় এবং মাছ খাওয়ার পরিমাণ যদি বেশি থাকে, তাহলে তাদের শিশুদের বোধশক্তি এবং ভাষার দক্ষতা ভালো হয়। গবেষকেরা বলছেন, অধিক ওজন ও স্থূল মায়েরা স্বাস্থ্যকর্মীর কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে চললে তাদের শিশুরা সুফল পেতে পারে।
ফিনল্যান্ডের ও যুক্তরাষ্ট্রের এগারো জন গবেষক এ কাজে যুক্ত ছিলেন। তাঁদের গবেষণাপ্রবন্ধ ৩ জানুয়ারি স্বাস্থ্য সাময়িকী পেডিয়াট্রিক রিসার্চের অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত হয়েছে। সাময়িকীটি আমেরিকান পেডিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন এবং ইউরোপিয়ান সোসাইটি ফর পেডিয়াট্রিক রিসার্চের প্রাতিষ্ঠানিক প্রকাশনা।
পরিকল্পিত গর্ভধারণের কোনো বিকল্প নেই। গর্ভকালে সুষম খাবার খাওয়া, নিয়মিত ডায়াবেটিস পরীক্ষা করা ও নিয়ন্ত্রণে রাখা উচিত। গবেষণা বলছে, গর্ভকালে মাছ খেলে শিশুর জন্য ভালো। আমরা সেই অভ্যাস করতে পারি।
রেজাউল করিম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগের অধ্যাপক
প্রবন্ধের শুরুতে গবেষকেরা বলেছেন, কয়েক দশক ধরে স্থূলতা বৈশ্বিক বোঝা হিসেবে আলোচনায় আছে। স্থূলতা সন্তান জন্মদানে সক্ষম এমন মায়েদের জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। ফিনল্যান্ডের ৪২ শতাংশ গর্ভবতী নারী স্থূল বা তাঁদের ওজন অত্যধিক। যেসব নারীর ওজন বেশি বা যাঁরা স্থূল তাঁদের বিপাক সমস্যা দেখা দেয়। তাঁরা গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন এবং স্বাভাবিক ওজনের নারীদের তুলনায় সন্তান জন্মদানকালে তাঁদের জটিলতা বেশি দেখা দেয়। এমন মায়েদের গর্ভের সন্তান বিরূপ পরিবেশে পড়ে এবং তার প্রভাব পড়ে স্নায়ুবিকাশে।
বাংলাদেশে এ ধরনের গবেষণা হয়েছে বলে শোনা যায়নি। তবে একাধিক গবেষণা বলেছে, দেশে নারীদের মধ্যে ডায়াবেটিসের প্রকোপ বাড়ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, দেশের গর্ভবতী নারীদের ১৪ থেকে ১৯ শতাংশ গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এ ছাড়া নারীদের মধ্যে স্থূলতার হারও বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফিনল্যান্ডের গবেষণার ফলাফল বাংলাদেশের জন্য অপ্রাসঙ্গিক নয়।
গবেষণায় ২০১৩ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৭ সালের জুলাই পর্যন্ত প্রাথমিকভাবে ৪৩৯ জন নারীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। তাঁরা ছিলেন গর্ভধারণের প্রাথমিক পর্যায়ে। গবেষণায় শেষ পর্যন্ত ছিল ২৪৩টি শিশু ও তাদের মায়েরা। গবেষকেরা গর্ভকালের পুরো সময়টা মায়েদের ওপর নজর রাখেন। পরবর্তী সময়ে মা ও শিশু উভয়ের ওপর নজর রাখা হয়।
গবেষকেরা মায়ের ওজন পরিমাপ করা, ডায়াবেটিস দেখা, মায়েরা প্রতিদিন কী খাচ্ছেন এসব তথ্য রাখার পাশাপাশি বুকের দুধ খাওয়ানোর অভ্যাসও দেখার চেষ্টা করেন। মায়েরা পুষ্টি জাতীয় কী খাবার খাচ্ছেন, শক্তি বৃদ্ধি করে এমন খাদ্য কী পরিমাণ খাচ্ছেন, তা জানার চেষ্টা করেন। মাছ খাওয়ার ব্যাপারে আলাদা নজর ছিল। অন্যদিকে স্বীকৃত পদ্ধতি অনুসরণ করে শিশুদের বোধশক্তি, ভাষা ও মটর বা সঞ্চালক পেশির কার্যকারিতা দেখার চেষ্টা করেন। গবেষকেরা বলছেন, গর্ভকালীন ডায়াবেটিস শিশুর স্নায়ুবিকাশে প্রভাব ফেলে, গর্ভকালে স্থূলতা শিশুর স্নায়ুবিকাশ বাধাগ্রস্ত করে। একইভাবে প্রভাব ফেলে বা বাধাগ্রস্ত করে গর্ভকালে মায়ের খাদ্যাভ্যাস। গবেষকেরা প্রতিটি ক্ষেত্রে নম্বর বা পয়েন্ট ব্যবহার করেছেন।
গবেষণায় দেখা গেছে, গর্ভকালে ডায়াবেটিস নেই, এমন মায়ের শিশুদের ভাষার দক্ষতা গর্ভকালে ডায়াবেটিস থাকা মায়েদের শিশুদের চেয়ে ভালো। তবে কেন এমন হয়, তা গবেষকদের কাছে স্পষ্ট নয়। তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, যেসব মায়ের শরীরে জমে থাকা চর্বির পরিমাণ তুলনামলকভাবে কম, তাঁদের শিশুদের বোধশক্তি চর্বি জমে থাকা মায়েদের শিশুদের চেয়ে বেশি। ভাষার দক্ষতা ও পেশি চলাচলের ক্ষেত্রেও পার্থক্য বেশি। স্থূলতার পাশাপাশি ডায়াবেটিস থাকা মায়েদের শিশুদের স্নায়ুর বিকাশ স্থূলতার পাশাপাশি ডায়াবেটিস না থাকা মায়েদের শিশুদের চেয়ে কম দেখা দেছে।
গবেষকেরা দেখেছেন, যেসব মা গর্ভকালে সার্বিকভাবে ভালো খাবার খেয়েছেন, তাঁদের সন্তানদের স্নায়ুবিকাশ পরিস্থিতি সার্বিকভাবে ভালো খাবার না খাওয়া মায়েদের সন্তানদের চেয়ে ভালো। বিষয়টি আরও বিস্তারিতভাবে দেখার চেষ্টা হয়েছে মাছ খাওয়ার অভ্যাস পর্যালোচনা করে। গর্ভকালে নিয়মিত মাছ খাওয়া মায়েদের শিশুদের ভাষা ব্যক্ত করার দক্ষতা তুলনামূলকভাবে বেশি।
উপসংহারে গবেষকেরা বলছেন, মায়ের গর্ভকালীন বিভিন্ন ধরনের শারীরিক পরিস্থিতি শিশুর স্নায়ুবিকাশকে প্রভাবিত করে। গর্ভকালে সঠিক খাবার খাওয়া, খাদ্যতালিকায় মাছের স্থান করে দেওয়া, স্বাস্থ্যকর্মীর পরামর্শ মেনে চলা শিশুর স্নায়ুবিকাশে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
ফিনল্যান্ডের গবেষণার ফলাফলের বিষয়ে মতামত জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগের অধ্যাপক রেজাউল করিম বলেন, ‘পরিকল্পিত গর্ভধারণের কোনো বিকল্প নেই। গর্ভকালে সুষম খাবার খাওয়া, নিয়মিত ডায়াবেটিস পরীক্ষা করা ও নিয়ন্ত্রণে রাখা উচিত। গবেষণা বলছে, গর্ভকালে মাছ খেলে শিশুর জন্য ভালো। আমরা সেই অভ্যাস করতে পারি।’