মেহেদির রঙে ১২৮ নারীকে স্বাবলম্বী হওয়ার পথ দেখিয়েছেন মিমি


ইব্রাহীম হোসেন সম্রাট , আপডেট করা হয়েছে : 11-02-2023

মেহেদির রঙে ১২৮ নারীকে স্বাবলম্বী হওয়ার পথ দেখিয়েছেন মিমি

যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আশানুরূপ ফল অর্জন করতে না পেরে হতাশ হয়ে পড়েছিলেন আবরিতা মিমি, সেই বিশ্ববিদ্যালয়েই এখন তাঁর ব্যবসা নিয়ে ‘প্রজেক্ট’ করেন অন্য কোনো শিক্ষার্থী। প্রাতিষ্ঠানিক বিবেচনায় এখনো তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডিই পেরোতে পারেননি। অথচ এর মধ্যেই পরিবারের ভরসা হয়ে ওঠার পাশাপাশি ১২৮ নারীকে স্বাবলম্বী হওয়ার পথ দেখিয়েছেন এই উদ্যোক্তা।

নওগাঁর এক সাধারণ পরিবারের মেয়ে আবরিতা মিমি। চার বোনের মধ্যে দ্বিতীয়। বাবার স্বপ্ন ছিল মিমি চিকিৎসক হবেন। সুযোগ না পেয়ে রাজধানীর নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে মার্কেটিং বিভাগে ভর্তি হন মিমি। মায়ের সমর্থনও ছিল। ভালোই চলছিল। কিন্তু সপ্তম সেমিস্টারে গিয়েই বিপত্তি, ফলটা মনমতো হলো না। ফল প্রকাশের পরদিন ফেসবুকে মেহেদি নিয়ে একটি ‘লাইভ’ চোখে পড়ল। মুহূর্তেই মনে হলো, তিনিও তো মেহেদি নিয়ে কাজ করতে পারেন!


যেই ভাবা, সেই কাজ

সেদিনই (৫ মে ২০১৯) পেজ খুললেন ফেসবুকে। ‘মেহেদি বাই মিমি’। মনোযোগ দিয়ে ইন্টারনেটে মেহেদিশিল্পের কলাকৌশল দেখা শুরু করেন। আঁকাআঁকিতে পারদর্শিতা কম থাকায় একসময় পরীক্ষার ফলেও যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, সেই মিমিই ক্রমাগত চর্চায় রপ্ত করলেন নিখুঁত কাজের কৌশল। ‘মেহেদির কোন কীভাবে ধরতে হয়, তা–ও জানতাম না,’ বলছিলেন আবরিতা মিমি। ‘দেখে দেখে শিখেছি। রেখা দেখলেই নকশার ধারাটাকে বুঝতে পারতাম। প্রথম দিকে পরিবারের সহায়তা পাইনি। সহপাঠীদের অবজ্ঞা ও উপহাসের শিকার হয়েছি। অপরিচিত মানুষের বাসায় মেহেদি লাগিয়ে দিতে যাই বলে এলাকার মানুষ এবং আত্মীয়রাও বাবাকে কথা শোনাতে ছাড়েননি। বাবা ছিলেন সেই সময়ের ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান। মফস্‌সলের পরিপ্রেক্ষিতে আমার বাবাও বুঝতে পারছিলেন না যে আমি আসলে কী করছি। কিন্তু এখন আমার কাজে আমার স্বামী এবং মা-বাবাও যুক্ত।’ যে সহপাঠীরা উপহাস করতেন, তাঁরাও এখন গর্বভরে মিমির পরিচয় দেন।

পেজ খোলার তিন মাস পর কাজ পেতে শুরু করেন মিমি। ২০১৯-এর শেষ দিকে কাজে কয়েকজন সদস্যকে যুক্তও করেন। করোনা অতিমারিতে মেহেদিসন্ধ্যার আয়োজন হতো না। তখন অনলাইনে মেহেদি নিয়ে কাজ করেই ডলারে রোজগার করেছেন। মেহেদিশিল্পী হিসেবে নামডাক হওয়ায় কেউ কেউ তাঁর কাছে মেহেদির নাম চাইতেন। তাঁর পরামর্শমতো অনেকে মেহেদি কিনছেন দেখে মাথায় এল মেহেদি তৈরির ভাবনা। ২০২১-এর এপ্রিলে শুরু করলেন কাজ। ফেসবুক পেজের নামেই ব্যবসায়িক কাগজপত্র হলো। রাসায়নিকের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই বলে মিমির অর্গানিক মেহেদিও পেল ব্যাপক জনপ্রিয়তা। একা সবটা সামলাতে পারছিলেন না। ধীরে ধীরে মেহেদি তৈরি ও বিপণনের জন্য গড়লেন আলাদা দল। দলের কেউ মেহেদির কোন বানান, কেউ মেহেদি ভরে কোনটি প্রস্তুত করেন, কেউ পার্সেল প্রস্তুত করেন, কেউ লেখেন অর্ডার স্লিপ। ফেসবুক পেজের মডারেটরও রয়েছেন। আছেন তত্ত্বাবধায়ক। ১২৮ নারীর কেউ শিক্ষার্থী, কেউ গৃহিণী; রয়েছেন তালাকপ্রাপ্ত নারীও। ফ্রিল্যান্স কাজেরও সুযোগ রয়েছে। আর্থসামাজিকভাবে অনগ্রসর নারীদেরই বেশি সুযোগ দিতে চান মিমি। এমন নারীও আছেন, যিনি এ কাজ করে নিজের মাকে অন্যের বাসায় কাজ করার কষ্ট থেকে মুক্তি দিতে পেরেছেন। আবার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক করেও কেউ আবেদন করেছেন কাজের জন্য।


স্বপ্নপূরণের পৃথিবী

রাজস্থানের সোজাত শহর থেকে আসে কাঁচামাল। কাঁচামাল বাংলাদেশে আনা, ভ্যাট, ট্যাক্স, ব্যবসায়িক লাইসেন্স ও অন্য কাগজপত্র সামলানো; ওয়েবসাইট ব্যবস্থাপনা—এসবের দায়িত্বে রয়েছেন ফয়সাল বিন একরাম, এই ব্যবসায়ে যুক্ত একমাত্র পুরুষ, মিমির জীবনসঙ্গী। তিনি কম্পিউটার সায়েন্স ও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক। রাজধানীর জোয়ারসাহারা এলাকার যে বাসায় থাকেন, সেখানকার একটি কক্ষ বাদে পুরোটাতেই মেহেদি তৈরির আয়োজন। ওই কক্ষেই আপাতত তাঁদের সংসার। নিজেদের বাসায় ওঠার পর এই বাসার পুরোটাতেই মেহেদি তৈরি হবে, মিমির এমনটাই ইচ্ছা। নওগাঁয় তাঁর মা-বাবার তত্ত্বাবধানে স্থানীয় নারীরা তৈরি করেন নখের মেহেদির তেল।

রাজধানীর একটি আবাসিক এলাকায় ছাত্রী হোস্টেলে থাকার সময়ই স্বপ্ন দেখতেন, এই এলাকায় নিজের একটি বিলাসবহুল বাসা হবে। কিছুদিন হয় সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। সে সময় ডেভেলপার কোম্পানির কর্মকর্তারাও অবাক হয়েছিলেন, এত কম বয়সে কাউকে নিজস্ব অর্থে এমন বিলাসবহুল বাসা নিতে দেখেননি তাঁরা আগে। দুই মাস অন্তর মেহেদিশিল্পের প্রশিক্ষণেরও আয়োজন করেন তিনি। এ পর্যন্ত তাঁর পেজে ‘লাইক’ দিয়েছেন সাড়ে চার লাখের বেশি মানুষ, পেজটির অনুসরণকারী আছেন সাড়ে পাঁচ লাখের বেশি। ভারতের রাজস্থানে তৈরি হবে মিমির মেহেদি—একটু একটু করে এমন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথেও এগোচ্ছেন। পড়ালেখাটাও শেষ করার পরিকল্পনা আছে।


Publisher & Editor :Md. Abu Hena Mostafa Zaman

Mobile No: 01971- 007766; 01711-954647

Head office: 152- Aktroy more ( kazla)-6204  Thana : Motihar,Rajshahi
Email : [email protected], [email protected]