যৌনমিলন উপভোগের বিষয়। কিন্তু অনেক নারীর কাছে যৌন সম্পর্ক ধারালো বস্তুর আঘাতের মতো। যেমন হ্যানা ভ্যান ডি পিয়ার, যার যৌনমিলনের সময় যন্ত্রণা হওয়ার এক রোগ রয়েছে। ‘ভ্যাজাইনিজমাস’ নামের এই ব্যাধি সারা বিশ্বের নারীদের জীবনকে প্রভাবিত করে থাকে। তিনি বলেছেন, ‘আমার শরীর আমাকে সেক্স করতে দেয় না এবং আমি যখন সেক্স করি, তখন এমন মনে হয় যে কেউ আমাকে ছুরিকাঘাত করছে।’
তবে এই বিষয়টি সম্পর্কে খুব অল্প মানুষই জানেন। মূলত এই ব্যাধিতে আক্রান্তদের শরীর যৌনমিলনের ভয়ে এ ধরণের প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে থাকে। হ্যানা বলেন, ‘আমি এমন অনেক নারীর সাথে কথা বলেছি যারা এই সমস্যায় ভুগেছেন। তাদের প্রায় সবার থেকে একটি অভিজ্ঞতার কথা জানতে পেরেছি, আর তা হল তারা খুব একাকীত্বে ভোগেন।’
যাদের ভ্যাজাইনিসমাস আছে, তাদের যোনিপথের পেশিগুলো শক্ত হয়ে যায় এবং যোনির পেশির ওপর আক্রান্ত নারীদের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। এতে কিছু ভুক্তভোগীদের যৌনমিলনের জন্য অনেক কষ্ট পেতে হয়। এসময় তাদের জ্বালাপোড়া এবং কাটা দেয়ার মতো যন্ত্রণা হয়। অনেকের পক্ষে ট্যাম্পন প্রবেশ করানোও বেশ কঠিন হয়ে যায়।
হ্যানার বয়স এখন ২১ বছর। তিনি তার প্রথম যৌনমিলনের অভিজ্ঞতার কথা মনে করতে গিয়ে বলেন: ‘আমাকে সবসময় শেখানো হয়েছিল যে কুমারীত্ব হারানো যন্ত্রণাদায়ক হয়ে থাকে। কিন্তু প্রথম যৌনমিলনের সময় আমার মনে হয়েছিল কেউ আমার ভেতরে ছুরি ঢুকিয়ে চারপাশে মোচড়াচ্ছে।’
কিছু নারী এটিকে শরীর কেটে যাওয়া বা ত্বকে সূঁচ ফোটানোর মতো অনুভূতি হিসাবে ব্যাখ্যা করেন। যুক্তরাজ্যের কনসালট্যান্ট গাইনোকোলজিস্ট লেয়লা ফ্রডশাম বলেছেন যে এটি যৌনতার ব্যাপারে সর্বশেষ ট্যাবুগুলোর একটি। তার ভাষায়, ‘প্রথমবারের যৌনমিলন নিয়ে চিন্তিত হওয়াই স্বাভাবিক, এবং সম্ভবত আমরা সবাই এই অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। তবে ভ্যাজাইনিসমাসে আক্রান্ত নারীরা আজীবন এই জাতীয় অনুভূতি নিয়ে বেঁচে থাকতে পারেন।’
শুধু হ্যানা নন, আমিনার কথাও বলা যায়। ২০ বছরের এই তরুণী ভ্যাজাইনিজমাসে আক্রান্ত। তিনি বলেছেন যে এই বিষয়টি তার জীবন চিরতরে বদলে দিয়েছে। তার ভাষায়, ‘ভ্যাজাইনিসমাস আমার বিবাহিত জীবনের আনন্দকে গ্রাস করেছে। আমি কখন সন্তান নিতে চাইব সেটা বেছে নেয়ার ক্ষমতাও আমার নেই।’
এই অবস্থা নারীর জীবনের যে কোন সময় ঘটতে পারে। যৌন রোগ থেকে শুরু করে সন্তান প্রসব বা যৌনতা নিয়ে কোন মানসিক আঘাত কিংবা মেনোপজ – এই সময়গুলোতে যে কোন অভিজ্ঞতার কারণে এই ব্যাধি নারীর জীবনে দেখা দিতে পারে। কিছু ভুক্তভোগী তাদের এই রোগটি তখনই আবিস্কার করেন, যখন তারা প্রথমবার সেক্স করার চেষ্টা করতে গিয়ে ব্যর্থ হন।
তবে ডাঃ লেয়লা ফ্রডশাম বলছেন যে ধর্মীয় কঠোর অনুশাসনও এক্ষেত্রে দায়ী হতে পারে, ‘কিছু লোক আছেন যারা ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্যে বেড়ে ওঠেন। কিন্তু তাদের একেবারেই কোনও সমস্যা থাকে না। তবে এমনও অনেকে আছেন যারা অনেকটা স্পঞ্জের মতো – তারা সব ইঙ্গিত এবং মন্তব্যগুলো টেনে নেন। এসব মন্তব্যের একটি হল, আপনার বিয়ের রাতে যৌনমিলন খুব যন্ত্রণাদায়ক হবে এবং কুমারীত্ব প্রমাণের জন্য আমরা দেখতে চাই যে মিলনের পর কিছু রক্ত বয়ে গেছে।’
যদিও আমিনাকে কুমারীত্ব প্রমাণের জন্য এমন কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করতে হয়নি, তবে এই নিয়ে চিন্তা সবসময় তার মাথায় ঘুরঘুর করতো। তিনি বলেন, ‘এটি সম্ভবত এমন একটি বিষয় ছিল যা আমাকে যৌন সম্পর্কের ব্যাপারে খুব ভয় দেখিয়েছে। আমার বিয়ের রাতে আমার মনে হয়েছিল যে আমার শরীর বন্ধ হয়ে গেছে। এ সম্পর্কে কথা বলা কঠিন, কারণ মানুষ তা বুঝতে পারবে না। তারা ভাববেন যে আমি বিষয়টিকে অতিরঞ্জিত করছি বা পুরো বিষয়টি আমার মনগড়া।’
হ্যানা ভ্যান ডি পিয়ারকে এক সময় বলা হয়েছিল যে সেক্স একজন নারীর জন্য কখনোই সুখকর হয় না। তার ভাষায়, ‘আমি একটি গির্জার স্কুলে গিয়েছিলাম এবং আমাকে বলা হয়েছিল যে যৌনতার ফলে রক্তাক্ত যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে, গর্ভধারণ হতে পারে অথবা এসটিডি হতে পারে।’
ইসলে লিনের মতো আরও কিছু নারীর ক্ষেত্রেও এই ব্যাধিটি তাদের সম্পর্কের উপর বড় ধরণের সংবেদনশীল প্রভাব ফেলেছে। তিনি বলেন, ‘আমার মনে আছে, আমি সত্যিই ভয় পেয়েছিলাম যে আমার সঙ্গী হয়তো ভাববে যে তার প্রতি হয়তো আমার কোন ভালবাসা নেই বা শারীরিকভাবে আমি তার প্রতি আকৃষ্ট নই।’
লজ্জা এবং ট্যাবু প্রায়শই নারীদের এই বিষয়ে সাহায্য চাওয়া থেকে বিরত রাখে। অথচ ভ্যাজাইনিসমাস নামের এই ব্যাধিটি চাইলেই নিরাময় করা সম্ভব। হ্যানা এবং আমিনা উভয়েই যৌন প্রশিক্ষকদের কাছ থেকে চিকিৎসা নিতে উদ্যোগী হয়েছেন। একই সঙ্গে সুস্থ স্বাভাবিক যৌনমিলনের বিষয়ে তাদের সাইকো সেক্সুয়াল থেরাপিও দেয়া হবে। ভ্যাজাইনিসমাস নিরাময়ে শারীরিক ও মানসিক দুই ধরণের চিকিৎসাই দেয়া হয়ে থাকে।
আমিনা জানান, এটি একটি পর্যায় পর্যন্ত অনেক সহায়তা করেছে। ‘আমি পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিবাহিত জীবন যাপন করছি এবং আমার মনে হয় আমি আরও ভাল হওয়ার পথে যাচ্ছি।’
এই চিকিৎসা প্রক্রিয়ায় নারীদের মানসিক দিকটির প্রতিও গুরুত্ব দেয়া হয়ে থাকে। এজন্য মনস্তাত্ত্বিক পরামর্শ বা সাইকো সেক্সুয়াল কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে যৌনমিলনের মানসিক ভয় দূর করার চেষ্টা করা হয়। গ্লাসগোর কুইন এলিজাবেথ বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ ভেনেসা ম্যাককে বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেছেন, ‘এটি একধরণের কথা বলার থেরাপি, যা আপনার শরীরের ব্যাপারে আপনার অনুভূতিগুলো আরও বেশি করে বুঝতে এবং কিছু নেতিবাচক চিন্তা পরিবর্তন করতে সহায়তা করে।’
হ্যানা জানান, যে তার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে, তবে যৌনমিলন এখনও তার কাছে কঠিন মনে হয়। তবে তিনি বিষয়গুলিকে আরও উন্নত করতে, আরও পরিবর্তন করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তিনি বলেন, ‘আমি এমন যৌনমিলন করতে চাই যা আমি উপভোগ করবো। আমি চাই আমার মাসিক চলার সময়ে আমি যেন ট্যাম্পন পরে হাটতে পারি। আমি নিজের জন্য ছোট ছোট লক্ষ্য নির্ধারণ করেছি এবং আমি ভবিষ্যতের জন্য সেই লক্ষ্য অর্জনের পথে কাজ করে যাচ্ছি।