জীববৈচিত্র্যে ভরপুর সীতাকুণ্ড উপকূলীয় এলাকা। এই উপকূলের পাঁচটি মৌজায় দুই হাজার হরিণসহ ১০৮ প্রজাতির বন্যপ্রাণী, ৯৮ প্রজাতির পাখি ও ২১ প্রজাতির উদ্ভিদ আছে। জীববেচিত্র্যে সমৃদ্ধ সীতাকুণ্ড উপকূলকে বিশেষ জীববৈচিত্র্যপূর্ণ এলাকা ঘোষণায় কাজ করছে উপকূলীয় বন বিভাগ।
শুক্রবার দুপুরে এমন তথ্য জানিয়েছেন চট্টগ্রাম উপকূলীয় বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবদুর রহমান। তিনি বলেন, বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপকূলের প্রায় ৪০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ৬৫০৭ একর বনভূমি রয়েছে। যেখানে শিল্পায়নের নামে শিপইয়ার্ড স্থাপন চলছে প্রতিনিয়ত। এতে ধ্বংস হচ্ছে এলাকার পরিবেশ রক্ষাকারী উদ্ভিদ ও বন্যপ্রাণী। ফলে এই এলাকাকে বিশেষ জীববৈচিত্র্যপূর্ণ এলাকা ঘোষণার প্রক্রিয়া চলছে।
তিনি বলেন, হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপের মতো মিরসরাই এলাকাতেও ১৯৯৪ সালে তিন জোড়া হরিণ ছাড়া হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরীর হওয়ার পর গাছ কেটে ফেলায় হরিণগুলো সীতাকুণ্ড উপকূলে চলে যায়। এখনও হরিণগুলোকে খুব ভোর ও সন্ধ্যাবেলায় দেখা যায়। এই হরিণসহ নানা প্রাণীর বিচরণ আছে সীতাকুণ্ড উপকূলে। এগুলো রক্ষার জন্য বন অক্ষত রেখে পুরো এলাকাটিকে বিশেষ জীববৈচিত্র্য এলাকা ঘোষণার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
বন বিভাগের এই কর্মকর্তা জানান, গত ৩ জুলাই অনুষ্ঠিত মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে সীতাকুণ্ড উপকূলের বনভূমিকে জীববৈচিত্র্য এলাকা ঘোষণার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়।
সভায় উপস্থিত বন বিভাগের কর্মকর্তারা মতামত তুলে ধরে বলেন, ইকোপার্কের ক্ষেত্রে পর্যটক নিয়ন্ত্রণের সুযোগ কম থাকায় জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের আশঙ্কা থাকে। আবার বিশেষ জীববৈচিত্র্য এলাকা ঘোষণা করা হলে পর্যটক প্রবেশ নিষিদ্ধ করা যাবে। এতে জীববৈচিত্র্য রক্ষা পাবে।
সভায় মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দুটি সিদ্ধান্ত জানানো হয়। এগুলো হলো-প্রস্তাবিত গুলিয়াখালী বিশেষ জীববৈচিত্র্য এলাকা ঘোষণার প্রশাসনিক ও টেকনিক্যাল তথ্য সমন্বয়ে কনসেপ্ট নোট তৈরি করতে হবে। যে নোটে গুলিয়াখালী কোস্টাল বে-ভিউ ইকোপার্কের পরিবর্তে গুলিয়াখালী বিশেষ জীববৈচিত্র্য এলাকা ঘোষণার যৌক্তিকতা উল্লেখ করতে হবে।
একই সঙ্গে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে ম্যানেজমেন্ট অ্যাকশন প্ল্যানের খসড়া তৈরির কথাও জানানো হয়। এ প্ল্যান তৈরির ক্ষেত্রে চারটি বিষয়কে বিবেচনায় নিতেও নির্দেশনা দেওয়া হয়। মন্ত্রণালয়ের দুটি সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দিয়ে ম্যানেজমেন্ট অ্যাকশন প্ল্যান অনুযায়ী চারটি বিষয় নিয়ে কাজ করছে বন বিভাগ।
উপকূলীয় বন বিভাগের এই বিভাগীয় কর্মকর্তা বলেন, মন্ত্রণালয়ের সভায় বিশেষ জীববৈচিত্র্য এলাকা ঘোষণা নিয়ে পজেটিভ কথাবার্তা হয়েছে। মন্ত্রণালয় কিছু সিদ্ধান্ত দিয়েছে। সেগুলো বাস্তবায়নের কাজ চলছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে সীতাকুণ্ড ের প্রায় সাড়ে ৬ হাজার বনভূমি রক্ষায় বড় ধরনের উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে বন বিভাগ।
বন বিভাগ সূত্র জানায়, গত বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি সীতাকুণ্ড উপকূলের চারটি বিটের পাঁচটি মৌজার ৬৫০৭ একর বনভূমিকে গুলিয়াখালী বিশেষ জীববৈচিত্র্য এলাকা ঘোষণার প্রস্তাব দেয় বন বিভাগ। প্রস্তাবিত মৌজার পূর্বে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধ, পশ্চিমে সন্দ্বীপ চ্যানেল, উত্তরে মিরসরাই উপজেলার ডোমখালী খাল ও দক্ষিণে গুপ্তাখালী মৌজায় ১৯২৭ সালের বন আইনের ৪ ধারায় ১৬০১ একর, ৬ ধারায় ৩৫৭ একর এবং ২০ ধারায় ৪৫৪৭ একর মিলিয়ে ৬৫০৭ একরের বনভূমি রয়েছে।
বন বিভাগের তথ্যানুযায়ী, প্রস্তাবিত এই বনে হরিণসহ ১০৮ ধরনের বন্যপ্রাণী যেমন কোবরা, গোখরা, দারাস, কেওটে সাপ, খেঁকশিয়াল ও মেছোবাঘ আছে। এ ছাড়াও ৯৮ প্রজাতির পাখি বসবাস করে। কেওড়া, বাইন, গড়ান, গেওয়া, সুন্দরী ও হারগোজাসহ প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো প্রায় ২১ প্রজাতির বৃক্ষ, লতা ও গুল্ম আছে এই বনে। এখনও সেখানে নিয়মিত হরিণের দেখা মিলে। কমপক্ষে দুই হাজার হরিণ আছে উপকূলীয় এই বনে। বনভূমি সংলগ্ন সাগরে বিরল ও মহাবিপন্ন প্রজাতির সামুদ্রিক কচ্ছপ বিচরণ ও প্রজনন করে। বনভূমির মধ্যে গুপ্তাখালী, গুলিয়াখালী, ছোট কুমিরা ও বাঁকখালী খালে মাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির জলজ প্রাণীর অবাধ বিচরণ রয়েছে।
সূত্র জানায়, উপকূলীয় রেঞ্জের ২৩ হাজার ৫০০ একর বনভূমি বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরের জন্য অধিগ্রহণ করায় সেখানে গাছ কর্তন করা হয়েছে। যে কারণে এতদিন সেখানে বিচরণ করা প্রায় দুই হাজার হরিণ ও অন্যান্য বন্যপ্রাণী প্রস্তাবিত বনভূমিতে আশ্রয় নিয়েছে। বর্তমানে পুরো এলাকা বন্যপ্রাণীর একমাত্র আবাসস্থল হিসেবে গণ্য হচ্ছে। আবার পুরো এলাকাটি জীববৈচিত্র্য এলাকা ঘোষণা করা হলে পর্যটন ব্যাহত হবে বলেও মতামত তুলে ধরা হয়। এ ক্ষেত্রে গুলিয়াখালী খালের দুই পাশে ১০০ একর এলাকাকে পর্যটনের জন্য উন্মুক্ত রেখে বাকি বনভূমিকে বিশেষ জীববৈচিত্র্যপূর্ণ এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা যেতে পারে।
প্রস্তাবিত বনভূমির একাংশ গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকত পর্যটন এলাকা হিসেবে খুবই সুপরিচিত। সেখানে থাকা লবণাক্ত জলাভূমি দেখতে খুবই নান্দনিক, যা উপকূলীয় এলাকার জন্য বিরল। এই সৈকত থেকে সূর্যাস্ত অবলোকন করা যায়। যা দেখতে প্রচুরসংখ্যক পর্যটক এই বনে যায়। যে কারণে পুরো এলাকাটি বিশেষ জীববৈচিত্র্য এলাকা ঘোষণা করলে বেড়িবাঁধ ও বেড়িবাঁধের ভেতরে অবস্থিত শিল্প প্রতিষ্ঠানসহ জনপদ প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের মতো দুর্যোগে ক্ষতি হওয়া থেকে সুরক্ষিত থাকবে।
উপকূল ধ্বংসে ১৭০ শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড: সীতাকুণ্ড উপজেলার সমুদ্র উপকূলে প্রায় ১৫ কিলোমিটারজুড়ে গড়ে উঠেছে শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড। ১৯৮০ সালে ফৌজদারহাট সাগর উপকূল এলাকায় ৪টি ইয়ার্ড থেকে যাত্রা শুরু হয় এই শিল্পের। বর্তমানে ভাটিয়ারি, মাদাম বিবির হাট, সোনাইছড়ি, জোড়ামতল কুমিরা ও দক্ষিণ বাঁশবাড়িয়া পর্যন্ত প্রায় ১৭০টি ইয়ার্ড গড়ে উঠেছে।
এর মধ্যে নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে ৬০-৬৫টি শিপ ইয়ার্ড চালু রয়েছে। এসব শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে তিন লাখ শ্রমিক কাজ করে। যে কারণে ধ্বংস হচ্ছে সীতাকুণ্ড উপকূলীয় এলাকার পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য।
সম্প্রতি শিল্প মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় ২০২৩ সালের মধ্যে সব শিপ ইয়ার্ডকে গ্রিন শিপ ইয়ার্ডে উন্নীত করার লক্ষ্যে শিপ রিসাইক্লিং ফ্যাসিলিটি প্ল্যান বাস্তবায়নের কাজ চলছে। আর এই কার্যক্রম বাস্তবায়নে মালিকগণ ব্যাংক ঋণের সহায়তায় বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করছেন। সরকার যদি এই শিল্প জোন এলাকায় স্মার্ট সিটিসহ অন্য কোনো কর্মযজ্ঞ গড়ে তোলে তাহলে শিপ মালিকরা পুঁজি হারিয়ে পথে বসবেন বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি ও আরেফিন এন্টার প্রাইজ শিপ ইয়ার্ডের মালিক আলহাজ মো. কামাল উদ্দিন। অবশ্য এতে জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের তথ্যও স্বীকার করেন কামাল উদ্দিন।