মার্টিন উলফ লন্ডনভিত্তিক ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের প্রধান অর্থনৈতিক বিশ্লেষক। তাকে বলা হয়েছিল মাত্র তিনটি শব্দে ২০২২ সালের অর্থনীতিকে বর্ণনা করতে। মার্টিন বলেছিলেন, যুদ্ধ, মূল্যস্ফীতি ও জ্বালানিসংকটের ধাক্কা। কিন্তু এই তিন সংকটই কি একই রকম থাকবে নতুন বছরেও। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুদ্ধ, মূল্যস্ফীতি ও জ্বালানিসংকটের প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি সংকুচিত হবে। দেখা দেবে অর্থনীতির মন্দা। এমন পরিস্থিতিতে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাকি ছয় মাসের (জানুয়ারি-জুন) জন্য নতুন মুদ্রানীতি আগামী ১৫ জানুয়ারি ঘোষণা করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে দেশের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে পণ্যের চাহিদা ও সরবরাহ কমিয়ে আনা এবং বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদেরা। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে আসছে মুদ্রানীতি কেমন হওয়া উচিত, সে বিষয়ে ইত্তেফাকের সঙ্গে কথা বলেছেন দেশের প্রখ্যাত দুই অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান ও বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন।
মুদ্রানীতিকে সামনে রেখে অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা বিশ্লেষণ করে অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান ইত্তেফাককে বলেন, অর্থনীতিতে শুধু বাংলাদেশ দেশ নয়, সারা বিশ্বের এক নম্বর সমস্যা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। এর মধ্যে ডলারের সংকটও বড় সংকট। এক. মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে জিনিসপত্র অতিরিক্ত ক্রয় নিয়ন্ত্রণ করা যায়। যাতে মানুষ প্রয়োজনের অতিরিক্ত পণ্য ক্রয় না করে। দুই. পণ্যের সরবরাহ বাড়িয়ে ফেলা যায়। এই দুটো ব্যবস্থা দিয়ে যেকোনো কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের বাজারে যে পরিমাণ তারল্য আছে সেটা আস্তে আস্তে কমিয়ে ফেলার চেষ্টা করে। সারা পৃথিবীতে তাই ঘটছে। এখন মানুষের চাহিদা বেড়ে গেছে। এটি অতিরিক্ত চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এটি করতে হলে নীতি সুদ হার কমাতে হবে।
আরেকটি বিষয় হলো, এ সময়ের মূল্যস্ফীতি হলো আমদানি করা মূল্যস্ফীতি। এটি নিয়ন্ত্রণ করতে হলে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার ম্যানেজমেন্ট খুব জরুরি। আমাদের দেশে একাধিক বিনিময় হার আছে। সেটিকে একটি একচেঞ্জ রেটে আনা যায় কি না ভাবতে হবে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক চেষ্টা করছে। আমার মনে হয়, সেদিকে যেতে হবে। এটি মুদ্রানীতির বড় একটি কৌশল।
তিন হলো, আমাদের দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই একমাত্র লক্ষ্য হতে পারে না। আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি উন্নয়নমুখী কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মালটিপল টার্গেট থাকতে হবে। যেমন উত্পাদনশীল খাতকে উন্নয়ন করতে সাহায্য করবে। জলবায়ুর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য সবুজ অর্থায়ন জোরদার করতে হবে এবং বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হারের ক্ষেত্রে আরো মুনশিয়ানা দেখাতে হবে। এসব মিলিয়ে একটি ভারসাম্যপূর্ণ মুদ্রানীতি আমরা চাচ্ছি। আমি এটিকে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি বলব না। আমি বলব, উন্নয়ন সমর্থক একটি ভারসাম্যপূর্ণ মুদ্রানীতি দিতে হবে। যেখানে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হবে এবং উন্নয়নকে সমর্থন করা হবে।
- ডলারের অভিন্ন দর ঠিক করতে হবে: ড. জাহিদ হোসেন
মুদ্রানীতিকে সামনে রেখে অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা বিশ্লেষণ করে বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন ইত্তেফাককে বলেন, আমাদের অর্থনীতির সামনে মূল্যস্ফীতি আর ডলারের সংকট বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতি মন্দার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে উন্নত বিশ্বের এই মন্দার ধাক্কা উন্নয়নশীল বিশ্বেও পড়ছে। যেসব অর্থনীতির দেশ রাশিয়ার জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল, তারা মন্দার কবলে পড়বে। আমরা ডলারের সংকট মোকাবিলার জন্য এ পর্যন্ত আমদানিকে চেপে রাখার চেষ্টা করছি। কিন্তু আমদানিকে এভাবে চেপে রাখলে উৎপাদন ব্যাহত হবে। একে চেপে রাখা যাবে না। এ নীতি থেকে বাংলাদেশ ব্যাংককে বের হতে হবে।
আসছে মুদ্রানীতি প্রসঙ্গে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, একটা মুদ্রানীতি ইতিমধ্যে ঘোষণা করা আছে। এখন দেখার বিষয় প্রথম ছয় মাসে অর্থনীতিতে যা ঘটেছে বিশেষ করে মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে তার ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বাকি ছয় মাসের জন্য নীতিতে কী ধরনের পরিবর্তন আনে। এখানে বাংলাদেশ ব্যাংককে ভাবতে হবে তাদের করনীয় যতটুকু তাতে তারা কী করবে। যদিও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর পুরোপুরি নির্ভর করে না।
প্রথমত, সরকারের ঋণগুলো পুরোপুরি অর্থায়ন হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে। যা টাকা ছাপিয়ে করা হয়েছে। এর ফলে রিজার্ভ মানির পরিমাণ বেড়ে যায়। আমার মতে, যদিও এটির প্রভাব এখনো মূল্যস্ফীতির উপর পড়েনি। কারণ একদিকে যেমন কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারকে টাকা দিয়েছে অন্যদিকে ডলার বিক্রি করেছে। এর কারণে প্রচুর টাকা ব্যাংকিং সিস্টেম থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে চলে এসেছে। যার কারণে মোট সরবরাহের উপরে তেমন প্রভাব পড়েনি। একটি আরেকটির মধ্যে কাটাকাটি হয়ে গেছে। কিন্তু ডলার বিক্রি বাংলাদেশ ব্যাংক আর কতদিন করবে। রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। বাজেট ঘাটতিতে যে অর্থায়ন করা হচ্ছে তাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। এখানে বাংলাদেশ ব্যাংক কী বলে তা দেখার বিষয়। সাধারণত এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে না।
দ্বিতীয়ত, যেটি আমরা বারবার বলছি কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক তা আমলে নিচ্ছে না। মুদ্রানীতিকে মূল্যস্ফীতির কাজে ব্যবহার করতে হলে সুদের হারের উপরে যে ক্যাপ আছে তা তুলে দিতে হবে। সুদহারের সীমা যদি ধরাছোয়ার বাইরে থাকে তাহলে মুদ্রানীতির মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করবে কীভাবে। মুদ্রানীতি মূল্যস্ফীতির কাজে আসে তখন যখন সুদের হার ওঠানামা করার সুযোগ থাকে। এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংক রেপো রেট দুই দফা বাড়িয়েছে। এটি বাড়িয়ে কোনো লাভ নেই যদি লেন্ডিং রেট ফিক্সড থাকে। যদিও পারসোনাল লোনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক আন-অফিসিয়ালি ছাড় দিয়েছে। যদিও এটির কোনো ঘোষণা বা প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়নি। সব ব্যাংক তো একভাবে মৌখিক নীতি অনুসরণ করতে পারে না। এ মৌখিক নীতি তো একটি অসচ্ছ পলিসি। এটির ওপর ভরসা করতে পারছে না ব্যাংকগুলো। মৌখিক নীতি থেকে সরে আসা উচিত। কারণ মুদ্রানীতি কখনো মৌখিক নির্দেশনায় চলতে পারে না। বাংলাদেশ ব্যাংক দুইভাবে কথা বলছে একটি ঘোষিত নীতি আরেকটি অঘোষিত বা মৌখিক নীতি।
তৃতীয়ত, বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হারের ক্ষেত্রে যে সিস্টেম (বিভিন্ন রেট) চলছে সেটা চলতে পারে না। এটিতে ডলারের জোগানে বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বারবার বলছে তারা ভাসমান নীতিতে চলে আসবে। কিন্তু আসছে না। ভাসমান নীতি গত মার্চের আগে ছিল। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক হয়তো বলতে পারে এটি তো আমরা করিনি, করেছে বাফেদা। আমি মনে করি, বাংলাদেশ ব্যাংকের আশীর্বাদে বিভিন্ন রেট করা হয়েছে। এটিও আরেকটি অঘোষিত নীতি। এখন মুদ্রানীতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক কী বলে তা দেখার বিষয়।