প্রায় পাঁচ মাস আগে পিকআপ ভ্যানের ধাক্কায় দুর্ঘটনার শিকার হন মোটরসাইকেল আরোহী মেরিনা মিতু। এরপর প্রথম মাস তাঁর পুরোটাই কেটেছে হাসপাতালের বিছানায়। শুধু বাঁ হাতেই তিনবার অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে। দ্বিতীয় মাসে স্ক্রাচে ভর করে কিছুটা হাঁটা শুরু করেন।
বিজ্ঞাপন
এখনো পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেননি তিনি।
‘নিরাপদ সড়ক চাই’-এর তথ্যমতে, ২০১৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত চার বছরে ১৫ হাজার ৬৯০টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১৮ হাজার ৯২৪ জন নিহত হয়। আহত হয় ২৪ হাজার ৮৮৭ জন। সড়ক পরিবহন আইনে বলা আছে, কোনো মোটরযানের কারণে দুর্ঘটনায় কেউ আঘাতপ্রাপ্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত হলে কিংবা মারা গেলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা তার পরিবারকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ বা চিকিত্সা খরচ দিতে হবে। কিন্তু এত দিন বিধিমালা না হওয়ায় সেটা কার্যকর হয়নি। এখন বিধিমালা জারি হওয়ায় দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তরা সেটা দাবি করতে পারবে।
সড়ক পরিবহন আইনের ৫৩ ধারায় বলা হচ্ছে, ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য আর্থিক সহায়তা তহবিল নামে একটি তহবিল গঠন করা হবে। এই তহবিল পরিচালনা করতে প্রত্যেক মোটরযানের বিপরীতে মালিকদের কাছ থেকে বার্ষিক বা এককালীন চাঁদা আদায় করা হবে। মোটরযান মালিক বা প্রতিষ্ঠান তহবিলে এই চাঁদা দিতে বাধ্য।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, আইনের কঠোর বাস্তবায়ন না হলে দুর্ঘটনা কমবে না। এত দিন তো মানুষ ক্ষতিপূরণও চাইতে পারত না। এখন অন্তত নিজের অধিকার দাবি করতে পারবে।
সড়ক পরিবহন বিধিমালা ২০২২-এর ‘দুর্ঘটনার জন্য ক্ষতিপূরণ, চিকিত্সা এবং বীমা’ শীর্ষক অষ্টম অধ্যায়ে ক্ষতিপূরণের বিষয়ে বিস্তারিত বলা হয়েছে। যান মালিকদের চাঁদা দিয়ে আর্থিক সহায়তা তহবিল গঠন করতে বলা হয়েছে। বাস, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান মালিকরা বার্ষিক এক হাজার ৫০০ টাকা চাঁদা দেবেন। মিনিবাস, পিকআপ ৭৫০ টাকা, কার-মাইক্রোবাস ৫০০ টাকা এবং তিন চাকার যানের মালিকরা ৩০০ টাকা চাঁদা দেবেন। এ ছাড়া মোটরসাইকেল মালিকরা এককালীন এক হাজার টাকা চাঁদা দেবেন।
তহবিলের বিপরীতে বিআরটিএর চেয়ারম্যান, পরিবহন মালিক, শ্রমিক, বিশিষ্ট ব্যক্তিসহ ১২ জন ব্যক্তি নিয়ে একটি ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করা হবে। দুর্ঘটনার শিকার হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে ওই ব্যক্তি বা তার পরিবারের পক্ষ থেকে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন করতে হবে। পরবর্তী ১০ দিনের মধ্যে চেয়ারম্যান তদন্ত কমিটি গঠন করে ঘটনার সত্যতা খুঁজে পেলে ৩০ দিনের মধ্যে ক্ষতিপূরণের টাকা দিতে হবে।
২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সড়ক পরিবহন আইন পাস করে সরকার। ২০১৯ সালের ১ নভেম্বর থেকে আইনটি কার্যকর করা হয়। লম্বা সময় পেরিয়ে সড়ক পরিবহন বিধিমালা চূড়ান্ত করেছে সরকার। ফলে এখন সড়ক আইন শতভাগ কার্যকরে আর কোনো বাধা থাকছে না। গত রবিবার বিধিমালার কপি হাতে পায় কালের কণ্ঠ। এই বিধিমালাকে ‘সড়ক পরিবহন বিধিমালা ২০২২’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। এতে তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে ২৭ ডিসেম্বর। ফলে এই তারিখ থেকে বিধিমালা কার্যকর বলে বিবেচনা করা হবে। সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ পাস হওয়ার প্রায় চার বছর পর বিধিমালা জারি করা হলো।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার রবিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমিও আজ রাতেই বিধিমালার একটি কপি পেয়েছি। এতে অবিলম্বে কার্যকরের কথা উল্লেখ আছে। এখন আইন প্রয়োগ আরো কার্যকর হবে। ’
এদিকে চালক নিয়োগের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট শ্রেণির মোটরযান চালাতে ড্রাইভিং লাইসেন্স ও গণপরিবহন চালাতে অনুমতিপত্র (পিটিএ) এবং কন্ডাক্টর বা সুপারভাইজার নিয়োগের ক্ষেত্রে কন্ডাক্টর বা সুপারভাইজার লাইসেন্স থাকতে হবে বলে বিধিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া গণপরিবহনে চালক, কন্ডাক্টর বা সুপারভাইজার নিয়োগের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ডোপটেস্ট সনদ থাকতে হবে। বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ (২০০৬ সালের ৪২ নম্বর আইন) অনুযায়ী নির্ধারিত বেতন ও আর্থিক সুবিধাদি দিতে হবে। ২০ বছরের কম বয়সী কোনো ব্যক্তি কন্ডাক্টর বা সুপারভাইজার লাইসেন্স নিতে পারবে না বা এমন কোনো ব্যক্তির কন্ডাক্টর বা সুপারভাইজারের লাইসেন্স মঞ্জুর করা যাবে না বলা হয়েছে বিধিমালায়। মোটরযানে রেডিও, টেলিভিশন ইত্যাদি ব্যবহার করার বিষয়ে বলা হয়েছে, বাস বা মিনিবাসে চালক ছাড়া প্রত্যেক যাত্রীর আলাদাভাবে শ্রবণের জন্য ইলেকট্রনিক ডিভাইস স্থাপন করা যাবে। তবে জনগণের বিরক্তি সৃষ্টি হয় এমন কোনো রেডিও, টেলিভিশন ইত্যাদি কোনো মোটর কার, জিপ ও মাইক্রোবাসে চালানো যাবে না।
বিধিমালায় ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রাপ্তির শর্তে বলা হয়েছে, ন্যূনতম অষ্টম শ্রেণি বা জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) বা সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। দাখিল করতে হবে মেডিক্যাল সার্টিফিকেট। মোটরযান চালাতে দক্ষতা যাচাই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে।
বিধিমালা প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, এক রায়ে উচ্চ আদালতের অবজারভেশনে চালকদের শিক্ষাগত যোগ্যতার কথা মাধ্যমিক (এসএসসি) পর্যন্ত বলা হয়েছিল। কিন্তু এখানে অষ্টম শ্রেণি পাস দিয়েছে। বিধিমালায় আবার অতিরিক্ত ক্ষমতা ট্রাফিক পুলিশকে দিয়েছে। ট্রাফিক চাইলে লাইসেন্স স্থগিত করতে পারবে। এতে জটিলতা ও দুর্নীতি দুটিই বাড়বে।
বর্তমান আইনের ১০৫ নম্বর ধারায় দুর্ঘটনায় কোনো ব্যক্তি গুরুতর আহত বা নিহত হলে দায়ী ব্যক্তির সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড এবং পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। প্রস্তাবিত সংশোধনীতে আর্থিক ক্ষতিপূরণ পাওয়া থেকে আহতদের বাদ দেওয়া হচ্ছে। আর নিহত ব্যক্তির পরিবারকে পাঁচ লাখের পরিবর্তে তিন লাখ টাকার আর্থিক ক্ষতিপূরণের প্রস্তাব করা হচ্ছে।