করোনা মহামারিতে বিপর্যস্ত অর্থনীতি যখন আশার আলো দেখছিল ঠিক তখন যুদ্ধ বাঁধে হাজার মাইল দূরের দুই দেশের মধ্যে। যুদ্ধে বিশ্ববাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে আমদানি ব্যয়।টান লাগে রিজার্ভে। হুন্ডির থাবায় কমে যায় রেমিটেন্স। তীব্র হয় ডলার সংকট। কমতে থাকে রপ্তানি আয়। ইতিহাসের রেকর্ড গড়ে মূল্যস্ফীতি। শুধু বাংলাদেশই নয়, সমগ্র বিশ্বে এখনও সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি দাবড়ে বেড়াচ্ছে। তবে গত বছরের শেষভাগে এসে দেশের অর্থনীতিতে আশার আলো জ্বালায় রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয়। রেমিটেন্সের পালে হাওয়া লেগে ডিসেম্বরে আসে ১৭০ কোটি ডলার। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের কথা মাথায় রেখে ব্যয় সংকোচনে রিজার্ভে রীতিমতো খুঁটি লাগানো হয়। তবে অর্থনীতির এসব চ্যালেঞ্জ যত দ্রুত দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করা যাবে, তত দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে পারে অর্থনীতি- এ কথাই বলছেন অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, অর্থপাচার, হুন্ডি বন্ধ ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে নজরদারি বাড়াতে হবে। খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ করে ঋণ আদায় বাড়াতে হবে। এতে বৈদেশিক মুদ্রা ও তারল্য সংকট হবে না। একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতির হারও নিয়ন্ত্রণ করা যাবে বলে তারা মনে করছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সাধারণত বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সব সময়ই একটা ঊর্ধ্বমুখী ধারা দেখা যায়, তার একটা প্রভাব থাকবে অর্থনীতিতে।
করোনা মহামারির ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হলো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। ফলে ২০২০ ও ২০২১ সালে যেমন বিশ্ব গণমাধ্যমের বড় অংশ জুড়ে ছিল কোভিড, ২০২২ সালে দ্রুতই সেই জায়গা নিয়ে নিল যুদ্ধের খবর। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম তরতর করে বাড়তে থাকে। সেই সঙ্গে বেড়েছে ডলারের দামও। যুদ্ধের ডামাডোলে বর্তমানে বিশ্বের ১০৪টি দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ডবল ডিজিটের ওপরে। এর মধ্যে চারটি দেশের ১০০ ভাগের ওপরে রয়েছে। বাংলাদেশ যেসব দেশ থেকে পণ্য আমদানি করে ওই সব দেশেও মূল্যস্ফীতির হার বেশি। বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি করে চীন থেকে। ওই দেশে মূল্যস্ফীতির হার ২ দশমিক ৮ শতাংশ। আগে ছিল ১ শতাংশের কম। এরপরই ভারত থেকে বেশি আমদানি হয়। ওই দেশে মূল্যস্ফীতির হার ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। ব্রাজিলের মূল্যস্ফীতি ১১ দশমিক ৭ শতাংশ. যুক্তরাজ্যের ৯ দশমিক ১ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্রের ৮ দশমিক ৬ শতাংশ, কানাডার ৭ দশমিক ৭ শতাংশ, থাইল্যান্ডের ৭ দশমিক ১ শতাংশ। এসব দেশ থেকে পণ্য আমদানির নামে মূল্যস্ফীতি আমদানি করছে। ফলে দেশে এ হারে চাপ বাড়ছে। নতুন বছর ওইসব দেশে মূল্যস্ফীতির হার আরও বাড়তে পারে বলে আভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বাজারের তালিকা কাটছাঁট করেও সংসার চালাতে হিমশিম খেয়েছে সীমিত আয়ের মানুষ। বাজার পরিস্থিতি সামাল দিতে চাল, ভোজ্য তেলসহ বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য আমদানিতে শুল্ক সুবিধা দিয়েছে সরকার।
তার পরও গতবছরজুড়ে বাজারদরে নাভিশ্বাস ছিল ভোক্তার। সব মিলিয়ে দেশের মানুষকে বছরজুড়ে ভুগিয়েছে নিত্যপণ্যের দর। নতুন বছরে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করাই বাংলাদেশের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কামার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বলেন, আগামীর সব সময় সম্ভাবনার। তবে এবার নতুন বছরে সেই সম্ভাবনার ইতিবাচক দিকগুলোর চেয়ে শঙ্কা এবং অনিশ্চয়তাই বেশি। তিনি দাবি করেন, গত বছরজুড়েই অর্থনীতি বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ নানামুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে আসছে, যার কোনোটিই বিদায়ী বছরে ফেলে আসা সম্ভব হয়নি। অর্থাৎ চলমান এসব সমস্যা নতুন বছরের কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও বেশি বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে, যদি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ না হয়।
বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কৃষি উপকরণের দাম বৃদ্ধি, চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে চলতি বছর কৃষি উৎপাদন কমার আশঙ্কা রয়েছে। এতে কৃষি পণ্যের সরবরাহ কমে এর দাম বাড়তে পারে। ফলে অনেক দেশকে খাদ্য সংকটের মুখোমুখি হতে হবে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি বিষয়ক সংস্থার (এফএও) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে স্বল্প আয়ের মানুষ ইতোমধ্যে খাদ্য সংকটের মুখোমুখি হয়েছে। অর্থনৈতিক মন্দায় তাদের আয়ে চাহিদা অনুযায়ী খাদ্য কিনতে পারছে না।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে খাদ্যেও সরবরাহ কমায় আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়েছে। একই সঙ্গে ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রার মান কমেছে। ফলে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে খাদ্যের দাম বেড়েছে। এতে স্বল্প আয়ের মানুষ স্বাস্থ্যসম্মত খাবার কিনতে পারছে না। গত বছরে জিডিপির হিসেবে বিনিয়োগ সরকারি খাতে ৭ দশমিক ৬ শতাংশ ও বেসরকারি খাতে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। কিন্তু অনিশ্চয়তার কারণে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়ছে না। কর্মসংস্থানের ৯৫ শতাংশই বেসরকারি খাতে। ফলে এ খাতে নতুন কর্মসংস্থান বাধাগ্রস্ত হবে। করোনার আগে থেকেই কর্মসংস্থানের গতি মন্থর। করোনার কারণে ২০২০ সালে তা প্রকট হয়েছে। ২০২১ ও ২০২২ সাল জুড়েও তা অব্যাহত ছিল। ফলে এই সময়ে যারা চাকরির বাজারে এসেছেন তারা কর্মসংস্থানের সুযোগ পাননি। এদের জন্য নতুন বছরও হবে একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, চলমান বৈশ্বিক সংকটের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো ধারণাতীত গতিতে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি হওয়া। মূল্যস্ফীতি ও মন্দা সারা বিশ্বের মানুষের বাঁচার লড়াইকে আরও চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। অর্থনীতির এই অবনতির ধারা আরও কত সময় ধরে এবং কেমন তীব্রতার সঙ্গে চলমান থাকবে তা বলাও মুশকিল। তিনি বলেন, ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তা-কর্মজীবীসহ সর্বস্তরের জনতার আস্থা ধরে রাখার পাশাপাশি আমাদের সামনে যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে সেগুলোর বিষয়ে সচেতন থাকা একান্ত জরুরি। এককথায় বলে দেওয়া যায় যে আমদানিজনিত যে মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছে, সেটিই আমাদের জন্য এখন প্রধানতম চ্যালেঞ্জ। দ্বিতীয় গুরুতর চ্যালেঞ্জটি হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত নীতি সুদের হার বৃদ্ধি। বৈশ্বিক বাস্তবতায় প্রায় সব দেশের মুদ্রানীতিই সংকোচনমুখী। প্রায় সব কেন্দ্রীয় ব্যাংকই খুব দ্রুত সুদের হার বাড়িয়ে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্যই তাদের এমন করতে হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও রিজার্ভ ক্ষয় ঠেকানোসহ সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে এরই মধ্যে তাদের নীতি সুদহার খানিকটা বাড়িয়েছে। আসছে দিনগুলোতে এই সুদের হার হয়তো আরও বাড়াতে হতে পারে।
তবে নীতি সুদহার বাড়ার পর তা ব্যাংক পর্যায়েও যাতে ট্রান্সমিট করা যায় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। সে ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগেও একরকম ভাটার টান দেখা দেবে বলে মনে হয়। তাই চাহিদামতো বিনিয়োগ প্রবাহ চালু রাখাটা আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে সামনে আসছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমাদের স্থিতিশীল অর্থনীতি বেশ ধাক্কা খেয়েছে। এটা করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মতো বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণেও হয়েছে, পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনার নানা অক্ষমতার বিষয়ও কাজ করেছে। এখন বৈশ্বিক পরিস্থিতির বিষয়টি তো আগামীতেও যা ঘটবে তা আমাদের মোকাবিলা করতে হবে। কিন্তু দেশের ভেতরে বয়ে চলা সমস্যাগুলো তো নিজেদের স্বার্থেই আমাদের উন্নতি ঘটাতে হবে। এটাই নতুন বছরের বড় চ্যালেঞ্জ বলে আমি মনে করি। তিনি বলেন, বিশেষ করে গত বছরে সৃষ্ট খেলাপিঋণ কমিয়ে এনে ব্যাংক ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন, করখেলাপি থেকে বেরিয়ে আসতে রাজস্ব নীতির সংস্কার, বাস্তবায়ন সক্ষমতা, মুদ্রানীতি, বিনিময় হারের নীতি, সুশাসন এবং প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার বিষয়সহ অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে পুঞ্জীভূত সমস্যা রয়েছে, এর সবক্ষেত্রেই নতুন বছরে নজর দেওয়া জরুরি। এর পাশাপাশি নতুন বছরে নতুন করে যোগ হবে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং আইএমএফসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থার দেওয়া যেসব শর্ত রয়েছে তা প্রতিপালন করতে গিয়ে এ কেন্দ্রিক যে টানাপোড়েন মোকাবিলাও একটা নতুন চ্যালেঞ্জ। এই অর্থনীতিবিদ মনে করেন, সরকারের উচিত নির্বাচনী বছরে রাজনৈতিক টানাপোড়েনের এই চাপ দক্ষতা ও সহনশীলতার সঙ্গে মোকাবিলা করে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা ও মানুষকে স্বস্তিতে রাখতে যতটা সম্ভব জনমুখী সিদ্ধান্তে যাওয়া।
অন্যদিকে, দাতাদের শর্তগুলোকে চাপ হিসেবে না দেখে অর্থনীতির স্থিতিশীলতার স্বার্থে তা অতি দ্রুত বাস্তবায়নে পদক্ষেপে যাওয়া। তবে এর জন্য সামাজিক সুরক্ষামূলক কর্মসূচিগুলোতে সরকারি ব্যয় আরও বাড়ানোর চাপও একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।