মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে গতকাল বিকালে রাজধানীতে লাখো মানুষের ঢল নামিয়ে বর্ণাঢ্য বিজয় শোভাযাত্রা করেছে আওয়ামী লীগ। ঢাকা মহানগরীর ১৫টি নির্বাচনী এলাকা, ৪১টি থানা এবং শতাধিক ওয়ার্ড থেকে বহু মিছিলের স্রোত এসে মিশেছিল ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সামনে। পুরো রাজধানীই পরিণত হয়েছিল মিছিলের নগরীতে। বিজয় শোভাযাত্রাপূর্ব সমাবেশ থেকে দেশবিরোধী সব অপশক্তির ষড়যন্ত্র মোকাবিলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন আওয়ামী লীগের জাতীয় নেতৃবৃন্দ। তাঁরা বলেন, দেশবিরোধীদের প্রতিহত করবই।
৫১ বছর আগে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের যে স্থানে পাকিস্তানি হানাদাররা আত্মসমর্পণ করেছিল, ঠিক সেই স্থানটির সামনে থেকেই শোভাযাত্রা শুরু করে আওয়ামী লীগ। বিজয় শোভাযাত্রা ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে গিয়ে শেষ হয়।
বিকাল পৌনে ৪টায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে বিজয় র্যালি শুরু হয়ে শাহবাগ, কাঁটাবন, বাটার মোড়, এলিফ্যান্ট রোড, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, মিরপুর রোড হয়ে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে এসে শেষ হয়। প্রায় ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এ বিজয় র্যালিতে অংশ নেওয়া সব মানুষের কণ্ঠে ছিল ‘বিজয়ের এই দিনে, মুজিব তোমায় মনে পড়ে’, ‘মুজিবের বাংলায় রাজাকারের ঠাঁই নাই’, ‘জামায়াত-শিবির-রাজাকার, এই মুহূর্তে বাংলা ছাড়’।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সামনে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের মোড়ে দুটি ট্রাকে অস্থায়ী মঞ্চ বানিয়ে শুরু হয় বিজয় শোভাযাত্রাপূর্ব সমাবেশ। সমাবেশ থেকে দেশবিরোধী সব অপশক্তির ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন জাতীয় নেতৃবৃন্দ। তারা বলেন, বিএনপি-জামায়াত দেশবিরোধী চক্র নানা ষড়যন্ত্র করছে। এদের রুখে দিয়ে ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে আবারও আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনব। বাংলাদেশ নিয়ে আর কাউকে ছিনিমিনি খেলতে দেওয়া হবে না। কোনো ষড়যন্ত্রই বাংলাদেশের উন্নয়ন-অগ্রযাত্রা রুখতে পারবে না।
ঢাকা মহানগরী উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের যৌথ আয়োজনে এ মিছিলপূর্ব বিশাল আয়োজনের মধ্যেমে সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন মহানগরী উত্তরের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান। মহানগরী দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবিরের পরিচালনায় বিজয় মিছিলের উদ্বোধন করেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। উদ্বোধনী বক্তব্যে ওবায়দুল কাদের বলেন, খুনিদের বিরুদ্ধে খেলা হবে। একাত্তরের খুনি, পঁচাত্তরের খুনিদের বিরুদ্ধে খেলা হবে। খুনিদের আমরা পরাজিত করব। সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে রুখতে হবে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ আন্দোলনে খেলবে, নির্বাচনেও খেলবে। সেমিফাইনাল সামনে। ফাইনালে আন্দোলনেও তারা হারবে। নির্বাচনেও তারা হারবে।
ওবায়দুল কাদের বলেন, আমি মোটরসাইকেলে করে এসেছি। জনগণ, স্লোগান আর স্লোগান। বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী, শীতলক্ষ্যার সব ঢেউ আজ ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের এ উত্তাল সমাবেশে। সবাই প্রস্তুত। খেলা হবে ভোট চুরি, দুর্নীতি, লুটপাটের বিরুদ্ধে, হাওয়া ভবনের বিরুদ্ধে, একাত্তর ও পঁচাত্তরের খুনিদের বিরুদ্ধে। তিনি বলেন, আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিভেদ সৃষ্টির উসকানি দিচ্ছে বিএনপি। আজ আমেরিকান দূতাবাস, তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো টানাপোড়েন হলে কূটনৈতিকভাবে তাদের সঙ্গে ফয়সালা করব। নিরাপত্তার বিষয়ে তিনি বলেন, আমি যুক্তরাষ্ট্রসহ সব দূতাবাসকে আশ্বস্ত করছি, কূটনীতিকদের জন্য নিরাপত্তার কোনো অভাব বাংলাদেশে নেই। শেখ হাসিনার বাংলাদেশে, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে সবাই নিরাপদে থাকবেন।
বেগম মতিয়া চৌধুরী বলেন, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আজ মানুষ অন্নের নিশ্চয়তা পেয়েছে, বস্ত্রের নিশ্চয়তা পেয়েছে। তারা বাসস্থান পেয়েছে। শিক্ষা-চিকিৎসা পাচ্ছে। তাই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তিকে পরাজিত করে আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে। কৃষিমন্ত্রী আবদুর ড. রাজ্জাক বলেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকবে। পৃথিবীর কোনো শক্তি নেই আওয়ামী লীগকে ষড়যন্ত্র করে ক্ষমতাচ্যুত করবে। শাজাহান খান বলেন, আজ বিএনপি-জামায়াত ভেংচি মারে। আওয়ামী লীগ কোনো বানরের ভেংচিতে ভয় পায় না। অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, বিএনপি-জামায়াত অরাজকতা সৃষ্টি করে দেশ অস্থিতিশীল করতে চায়। তাদের এ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুর রহমান বলেন, বিএনপি-জামায়াত বাংলাদেশক পাকিস্তান বানানোর দুঃস্বপ্ন দেখে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এ দেশকে সন্ত্রাস, রাজাকার ও জঙ্গিবাদমুক্ত করব।
সাবেক মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম বলেন, সন্ত্রাসীরা আজ শেখ হাসিনার অগ্রযাত্রা ব্যাহত করতে চায়। সন্ত্রাসের মধ্য দিয়ে তারা দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায়। যে-কোনো মূল্যে এই সন্ত্রাসী বিএনপি-জামায়াতকে রাজপথে প্রতিহত করতে হবে। সাবেক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেন, বিএনপি-জামায়াত অপশক্তি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। এদের আমরা বাংলার মাটি থেকে বিতাড়িত করব।
যুগ্মসাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, দেশ যখন এগিয়ে যাচ্ছে তখন ওই পরাজিত শক্তি নতুনভাবে চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। এ বিজয়ের মাস থেকেই আমরা ঘোষণা দিতে চাই- পাকিস্তানি দোসর বিএনপি-জামায়াতকে নির্মূল করতে হবে। শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, এ দেশ নিয়ে, আমাদের স্বাধীনতা নিয়ে কাউকে ছিনিমিনি খেলতে দেওয়া যায় না। তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, তারা বলেছিল ১০ তারিখে নাকি সরকারকে বিদায় নিতে হবে। ১০ তারিখে বিএনপিই পরাজিত হয়েছে। যুগ্মসাধারণ আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, বিএনপি একটা সন্ত্রাসী দল। তাদের কাছে দেশ ও দেশের মানুষ কখনো নিরাপদ নয়।
সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম, প্রচার সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ, মহানগরী দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফী, উত্তরের সাধারণ সম্পাদক এস এম মান্নান কচি প্রমুখ।
বিজয় মিছিলে লাখো মানুষের স্রোত : প্রতিবারের বিজয় মিছিলের চেয়ে গতকালের চিত্রে ছিল ভিন্ন আমেজ। সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং ঢাকা মহানগরী উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের থানা-ওয়ার্ডের কমিটিকে সামনে রেখে নিজ নিজ শক্তির মহড়া দেখিয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। পিছিয়ে ছিলেন না সহযোগী সংগঠন যুবলীগ, ছাত্রলীগ, যুব মহিলা আওয়ামী লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, কৃষক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা-কর্মীরাও। পাড়া-মহল্লা, থানা-ওয়ার্ড থেকে খন্ড খন্ড মিছিল নিয়ে তারা যোগ দেন বিজয় মিছিলে। যুবলীগের পতাকা ও মাথায় ক্যাপের মিছিল দৃষ্টি কাড়ে সবার। ঢাকা-২ আসনের এমপি অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস, ঢাকা-৩ আসনের এমপি নসরুল হামিদ, ঢাকা-১১ আসনের এমপি এ কে এম রহমত উল্লাহ, ঢাকা-১৩ আসনের এমপি আসাদুজ্জামান খান, ঢাকা-১৫ আসনের এমপি কামাল আহমেদ মজুমদার, ঢাকা-১৬ আসনের এমপি ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ, ঢাকা-১৮ আসনের এমপি হাবিব হাসানের শোডাউন ছিল চোখে পড়ার মতো। এমপিদের পাশাপাশি শোডাউনে অংশ নিতে দেখা গেছে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটির কাউন্সিলর, বিভিন্ন থানা-ওয়ার্ডের শীর্ষপদ প্রত্যাশী সাবেক নেতাদেরও। যুবলীগ চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশের নেতৃত্বে বিশাল পতাকা মিছিল নিয়ে আসে যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি। আলেয়া সরোয়ার ডেইজী ও শারমিন সুলতানা লিলির নেতৃত্বে যুব মহিলা লীগ শোডাউন করে। জাতীয় ও মুক্তিযোদ্ধাদের পতাকা নিয়ে মিছিলে অংশ নেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধারাও। পুরো রাজধানীই যেন পরিণত হয়েছিল মিছিলের নগরীতে। তাদের মাথায় রক্তস্নাত লাল-সবুজের জাতীয় পতাকা। গালে আঁকা মানচিত্র খচিত পতাকা। সবার চোখেমুখে ছিল বিজয়ের তৃপ্তি। চারদিকের স্লোগানের ধ্বনিতে প্রকম্পিত হচ্ছিল পুরো রাজধানী। দূরদূরান্ত থেকে জয় বাংলা সেøাগান তুলে বাস-ট্রাকে চড়ে মিছিলে এসেছে বিজয়-আনন্দে উচ্ছল মানুষ। মিছিলে অনেকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক বিশাল নৌকা। এ বিজয় মিছিল শেষ হওয়ার কথা ধানমন্ডির বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে। যখন সেখানে পৌঁছে মিছিলের অগ্রভাগ, তখনো শাহবাগ থেকে বের হতে পারেনি মিছিলের অন্য প্রান্ত। আওয়ামী লীগের শোভাযাত্রার কারণে গতকাল শনিবার ছুটির দিন হলেও রাজধানীতে প্রচ- যানজট দেখা দেয়।