রাজশাহীতে অবহেলিত মানুষের গ্রাম চর-মাঝারদিয়া!


মাসুদ রানা রাব্বানী, রাজশাহী: , আপডেট করা হয়েছে : 27-11-2022

রাজশাহীতে অবহেলিত মানুষের গ্রাম চর-মাঝারদিয়া!

রাজশাহী মহানগরীর কোল ঘেষে বয়ে চলেছে শহররক্ষা বাঁধ। সেই ব্রিটিশ আমল থেকে এই বাঁধ’টি শহর রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। যা রাজশাহী তথা দেশের অধিকাংশ মানুষেরই জানা। এই শহররক্ষা বাঁধের মধ্যে অন্যত্তম একটি বাঁধের নাম টি’বাঁধ। সেখানে প্রতিদিন শত শত বিনোদন প্রেমিরা জড়ো হয়। এবার মূল কথায় আসি। টি’বাঁধ থেকে নৌকা যোগে পাড়ি দিলে পদ্মা নদীর ওপারে ধূ-ধূ বালু চর। এই বালুর চরের উপর দিয়ে প্রায় চার কিলোমিটার পায়ে হেঁটে গেলে একটি গ্রামের দেখা মেলে। গ্রামটির নাম চর মাঝারদিয়া। চমৎকার সবুজে ঘেরা গ্রামটি’তে রাস্তা-ঘাট তৈরী করা হলে পর্যটক ও বিনোদন প্রেমিরা আকৃষ্ট হবে তাতে কোন সন্দেহ নাই। বেড়ানোর জন্য মহানগরীর মানুষের দারুণ একটা উপহার হবে এই গ্রামটি।

সম্প্রতী আরএমপি পুলিশ কমিশনার মোঃ আবু কালাম সিদ্দিক এর সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন রাজশাহী রিপোর্টার্স ইউনিটির নেতৃবৃন্দ ও সদস্যরা। সাক্ষাতকালে পুলিশ কমিশনার চর-মাঝারদিয়া থেকে ঘুরে আসা অভিজ্ঞতার কথা এবং ওই গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রার কথা বলেন। তিনি আহবান জানান, সাংবাদিকদের ঘুরে আসার জন্য।

এরপর রাজশাহী রিপোর্টার্স ইউনিটির (আরআরইউ) সাধারণ সম্পাদক মোঃ আবু হেনা মোস্তফা জামানের উদ্দ্যোগে ১২জন সাংবাদিকের একটি টিম যান চর মাঝারদিয়া গ্রামে।  

সরেজমিনে গিয়ে গ্রামের বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, গ্রামটিতে ১২ হাজার মানুষের বসবাস। সেখানে পৌঁছানোর পর দৃৃশ্যমান যা দেখা যায় তা হলো- পুরো গ্রামে কোন পাকা রাস্তা নেই। গ্রামটিতে চর-নবীনগর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। কিন্তু প্রধান শিক্ষকের পদ শূণ্য। একজন সহকারী শিক্ষক মোঃ ইমাম হোসেন। তিনি প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়াও একটি সরকারী হাইস্কুল রয়েছে। কিন্তু স্কুল দু’টিতেই রয়েছে শিক্ষক সংকট। ফলে ছেলে, মেয়েদের স্কুলে যাওয়া আর আসা। পাঠদান তেমন একটা নেই। সেখানে একটি মাত্র কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। সেই ক্লিনিকে ডা. সাবরিনা সুলতানা শীউলী নামের একজন ভারপ্রাপ্ত ডাক্তার রয়েছেন। তবে তিনি সরকারী ছুটি বাদেও সপ্তাহে সর্বোচ্চ দুইদিন ক্লিনিকে আসেন। জরুরী কারণে কোন রোগী ফোন করলে তিনি ফোন রিসিভ করেন না বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। তাছাড়া সরকারীভাবে কোন ওষুধও রোগীদের দেয়া হয়না। 

ভুক্তভোগী একজন রোগী জানান, তার চোখ চুলকানো সমস্যা নিয়ে ক্লিনিকে ডাক্তার সাবরিনার কাছে যান। সমস্যা শুনে ডাক্তার বলেন আপনার এ্যালার্জি সমস্যা। প্রেসক্রিপশান লিখে দিচ্ছি শহর থেকে ওষুধ কিনে নিয়েন। তার দাবি, এই ডাক্তার যোগদানের পূর্বে ক্লিনিক থেকে বিভিন্ন রোগের ওষুধ দেয়া হতো। বর্তমানে রোগীদের কোন ওষুধ দেয়া হয়না। রোগীদের বলা হয় ওষুধ সাপ্লাই নাই। ১২ হাজার মানুষের গ্রামটিতে নিরাপত্তার জন্য একটি পুলিশ ফাঁড়ি প্রয়োজন। এছাড়াও এই গ্রামে প্রতিটি বাড়িতে গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া পালন করা হয়। অথচ সেখানে কোন পশু হাসপাতালও নেই। শুধু নেই আর নেই। তারপরও উপায় নেই বেঁচে থাকতে হবে। তাই সংগ্রাম করে বেঁচে আছেন এই চরাঞ্চলের মানুষ।

চর-মাঝারদিয়া গ্রামের কৃষক মোঃ জহুরুল ইসলাম জানান, চরমাঝারদিয়া গ্রামের বাসিন্দারা শতভাগ কৃষক। কৃষি কাজ করেই জিবিকা নির্বাহ করে থাকে। কৃষিকাজে প্রধান সমস্যা হচ্ছে পানি। চরে কৃষি কাজের জন্য জরুরী ভিত্তিতে সেচ ব্যবস্থা প্রয়োজন। ধান, গম সহ বিভিন্ন কৃষি ফসলের মধ্যে লটকোন ফল উৎপাদন হয় অনেক বেশি। এই ফল পারাপার করতে কৃষকদের অনেক বেশী খরচ হয়। লটকোন ফল পারাপারে ঘাটের ইজারদার ও নৌকার মাঝি কৃষকদের কাছে অনেক বেশী ভাড়া আদায় করে থাকে। ফলে এই সুস্বাদু ফলটি বিক্রি করে কৃষকরা তেমন লাভবান হতে পারে না।

তিনি আরও বলেন, মরিচ এখন ১০-২০ টাকা কেজি। কিন্তু এক বস্তা কাঁচা মরিচ নৌকাতে ভাড়া গুণতে হয় ৬০-৭০টাকা। সেই সাথে ঘাটের ইজারাদার নিচ্ছে ৬০-৭০ টাকা। নৌকা থেকে বস্তা নামাতে লেবার নেয় বস্তা প্রতি ১০-১৫। কয়েকটা ধাপ পেরুতে যা খরচ হয়, তাতে ফল বিক্রি করে মুনাফা ঘরে তুলতে পারেননা কৃষকরা। 

তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমারা কৃষকেরা ক্ষেত ভরা মরিচ উৎপাদন করি। নায্যমূল্য পাইনা বলে নিজেরা ব্যবহার করি। অবশিষ্ট মরিচ ক্ষেতেই ফেলে রাখি। কারণ এই মরিচ নদীর ওপারে নিয়ে যেতে যে টাকা খরচ হয়। তাতে মূলধন কিছুই থাকে না। 

মোঃ বাবু জানান, চরের গরু ব্যবসায়ীদের গরু বিক্রি করতে রাজশাহী সিটি হাটে যেতে হয়। গরু পারাপার করতে নৌকার মাঝি একটি গরু প্রতি ভাড়া গুণতে হয় ২৫০-৩০০ টাকা। আর খেয়া ঘাটের ইজারদার নেয় ৩০০ টাকা। সিটিহাটে গরু বিক্রি না হলে, ফিরিয়ে আনতে আবার ওই পরিমান টাকা খরচ হয়। অর্থাৎ প্রতিটি গরু পারাপারে মাঝি ও ইজারাদারকে খরচ দিতে হয় ১০০০ টাকা। তিনি আরও বলেন, আমারা দলবদ্ধভাবে ৩০-৪০টি গরু পারপার করি। মাত্র ২-৩ কিলোমিটারের এই পথে ভাড়াতেই চলে যায় ৩০-৪০ হাজার টাকা। 

মোঃ হুমায়ুন কবির জানান, ভোটের সময় দলে দলে কর্মী নিয়ে আসেন নেতা/প্রার্থীগণ। আশ্বাস দেয় রাস্তা হবে, হাসপাতাল হবে, স্কুল হবে, কলেজ হবে, পশু হাসপাতাল হবে, আপনাদের জিবন মানের উন্নয়নে সকল কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো। সবই মিথ্যা আশ্বাস। সত্য হলো চরের লোকের জীবনমান উন্নয়নের কথা ভাবে এমন নেতা নেই।

চরের বাসিন্দাদের সবচেয়ে জরুরী বিষয় হলো: সাহেব বাজার বড় কুঠি, টি’বাঁধ এলাকা দিয়ে রাস্তা নির্মাণ করা, শিক্ষার মান উন্নয়নে স্কুল দু’টিতে পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ দেয়া। জরুরী সেবায় পুলিশ ফাঁড়ি, হাসপাতালে চাহিদা অনুযায়ী ডাক্তার ও নার্স নিয়োগ, পশু হাসপাতাল নির্মাণ। তবেই দূর্ভোগ আর ভোগান্তি থেকে মুক্তি পাবে চর-মাঝারদিয়ার গ্রামের ১২হাজার মানুষ। 

নাম প্রকাশ না করা শর্তে একজন কৃষক জানান, ১৯৭১ সাথে দেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। পূর্ব পাকিস্তান হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশ। কিন্তু আমরা চরের মানুষ পূর্ব পাকিস্থান হিসেবেই রয়ে গেছি। তার ভাষ্য অনুযায়ী চর-অঞ্চল আরএমপি’র এরিয়া হওয়ার পরও আমরা অবহেলিত কেন? আমরা চরের মানুষ মনে করি রাজশাহী শহর আমাদের রাজধানী। কিন্ত সেই রাজধানীতে যেতে আমাদের জন্য রাস্তা নির্মান করা হয়না কেন? এমনই হাজারো প্রশ্ন চরের বাসিন্দাদের। 

সম্প্রতী রাজশাহী রিপোর্টার্স ইউনিটির (আরআরইউ) নেতৃবৃন্দরা বিভাগীয় কমিশনার জি.এস.এম জাফরুল্লাহ’র সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। এ সময় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক চর-মাঝার দিয়া গ্রামের মানুষের ভোগান্তির বিষয়ে অবগত করেন। সার্বিক বিষয় শুনে তিনি চরের মানুষের জন্য একটি নৌকা দেবেন বলে জানিয়েছেন। 

রাজশাহী জেলা প্রশাসক মোঃ আব্দুল জলিল এর সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎকালে একই বিষয়ে অবগত করা হয়। তিনি বলেন, চরাঞ্চারের মানুষের সমস্যা দেখতে শিঘ্রই চর-মাঝারদিয়া যাবো। ঘুরে এসে বিস্তারিত আপনাদের জানানো হবে বলেও জানান জেলা প্রশাসক।


Publisher & Editor :Md. Abu Hena Mostafa Zaman

Mobile No: 01971- 007766; 01711-954647

Head office: 152- Aktroy more ( kazla)-6204  Thana : Motihar,Rajshahi
Email : [email protected], [email protected]