ম্যানেজারের অস্ত্রোপচারে প্রসূতির মৃত্যু, ৫০ হাজারে রফা!


অনলাইন ডেস্ক: , আপডেট করা হয়েছে : 25-11-2022

ম্যানেজারের অস্ত্রোপচারে প্রসূতির মৃত্যু, ৫০ হাজারে রফা!

নিজ সন্তানের মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না মা সুরাতুন খাতুনসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা, চলছে শোকের মাতম। শোক সইতে না পেরে অসুস্থ হয়ে পড়েন সাবিনার ছোট বোন শাপলা আক্তার, বর্তমানে তিনি দিনাজপুরে চিকিৎসা নিচ্ছেন।  

জানা গেছে, চলতি মাসের ৩ নভেম্বর (বৃহস্পতিবার) দুপুরে স্থানীয় এক দালালের পরামর্শে সুরাতুন খাতুনের মেয়ে সাবিনা আক্তার (২২) প্রসব বেদনা নিয়ে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা পৌরসভার সরকারপাড়া এলাকার (বেসরকারি হাসপাতাল) একতা ক্লিনিকে ভর্তি হন। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের অভিযোগ, ক্লিনিকের ম্যানেজার তমিজ উদ্দীন চিকিৎসক না হয়েও ক্লিনিকে প্রসূতির অস্ত্রোপচার করেন।

এতে অকালে মৃত্যু হয়েছে গৃহবধূ সাবিনা আক্তারের। এ ঘটনায় ক্লিনিক ম্যানেজারসহ সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছে নিহত সাবিনার পরিবার। তবে ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ অভিযোগ অস্বীকার করেছে। আর ঘটনা সত্য হলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও স্থানীয় প্রশাসন। 

সাবিনা ঠাকুরগাঁও পীরগঞ্জ উপজেলার ভোমরাদহ ইউনিয়নের মণ্ডলপাড়া গ্রামের সাদেক আলীর স্ত্রী ও পার্শ্ববর্তী রাধিকাপুর গ্রামের শাহজাহান আলী ও সুরাতুন খাতুনের কন্যা। ক্লিনিকে সাবিনার অস্ত্রোপচারের পর এক পুত্রসন্তানের জন্ম হওয়ায় হাসি ও আনন্দে মেতে ওঠেন পরিবারের সদস্যরা। কিন্তু সেই আনন্দ কয়েক ঘণ্টা পরই বিষাদে পরিণত হয়।  

মৃত সাবিনার ভাই মাইনুদ্দীন রানা জীবন জানান, ৩ নভেম্বর বৃহস্পতিবার দুপুরে ভর্তির কিছুক্ষণের মধ্যেই তাড়াহুড়ো করে অভিজ্ঞ চিকিৎসক ছাড়াই ক্লিনিকের ম্যানেজার মো. তমিজ উদ্দীন নিজেই ওই প্রসূতির অস্ত্রোপচার করেন। পরদিন ৪ নভেম্বর শুক্রবার পেট ফুলে গেলে অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকেন সাবিনা। এ সময় ক্লিনিক ম্যানেজার তমিজ উদ্দীন এলে সাবিনা তাকে দেখিয়ে বলেন, ভাই এই ডাক্তার আমার সিজার করেছেন। পরে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তমিজ উদ্দীন তা অস্বীকার করে কক্ষ থেকে দ্রুত চলে যান।  

সাবিনার বাবা শাহজাহান আলী ও চাচা মোজাফফর হোসেন জানান, সাবিনার অবস্থার অবনতি হলে ৬ নভেম্বর উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে দিনাজপুর এম আব্দুর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসকরা স্বাস্থ্য পরীক্ষা শেষে জানান, ঠাকুরগাঁওয়ে ভুল অস্ত্রোপচারের কারণে সাবিনার খাদ্যনালি ছিদ্র ও পেটের ভেতরে বিভিন্ন অংশ কেটে গেছে। পরদিন ৭ নভেম্বর চিকিৎসাধীন অবস্থায় সাবিনার মৃত্যু হয়। ভুল অস্ত্রোপচার করে সাবিনাকে হত্যা করা হয়েছে, আর আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছে সদ্যোভূমিষ্ঠ শিশুটিও। ক্লিনিক ম্যানেজার তমিজ উদ্দীন তাদের মেয়েকে ভুল অস্ত্রোপচারে মেরে ফেলেছেন। এ ঘটনায় ক্লিনিক ম্যানেজার তমিজ উদ্দীন, ক্লিনিকের মালিকসহ সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি জানিয়েছে ভুক্তভোগী পরিবার ও এলাকাবাসী।

এদিকে এই চাঞ্চল্যকর ঘটনা ধামাচাপা দিতে স্থানীয় দালালের মাধ্যমে মৃতের স্বামী সাদেক আলীকে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ ম্যানেজ করে বলে অভিযোগ উঠেছে।  

নিহত সাবিনার স্বামী সাদেক আলী জানান, তাদের প্রতিবেশী আমিন মাস্টারসহ (স্থানীয় দালাল) ক্লিনিকের লোকজন বসে বিষয়টি মিটমাট করে ফেলা হয়েছে। এ জন্য তাঁকে ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। আর টাকা দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন স্থানীয় দালাল আমিন মাস্টার। তিনি জানান, মিলাদ মাহফিলের জন্য ওই টাকা দিয়েছে ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ।

পীরগঞ্জ ভোমরাদহ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান হিটলার হক জানান, স্থানীয় দালাল আমিন মাস্টার এর আগেও এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছেন। গ্রামের সাদাসিদা ব্যক্তিদের ফুসলিয়ে সরকারি হাসপাতালে না নিয়ে বেসরকারি ক্লিনিকে ভর্তি করান তিনি। যার ফলে অপচিকিৎসায় অকালে প্রাণ দিতে হয়েছে বেশ কয়েকজনকে।

ভুল অস্ত্রোপচারের কারণে সাবিনার অকালমৃত্যুর অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ক্লিনিক ম্যানেজার মো. তমিজ উদ্দীন। তিনি জানান, রোগীকে ভর্তিসহ যাবতীয় কাজ করে দিয়েছেন, কিন্তু তিনি অস্ত্রোপচার করেননি। ক্লিনিক মালিক দাহিরুল ইসলাম জানান, অভিজ্ঞ চিকিৎসক দিয়েই ওই রোগীর অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল। পরে গ্যাস ও শ্বাসকষ্টজনিত কারণে রোগীর পরিবার তাকে দিনাজপুরে নিয়ে যায়। এরপর তিনি আর কিছুই জানেন না।

ঠাকুরগাঁও সিভিল সার্জন ডা. নুর নেওয়াজ আহমেদ জানান, এ ঘটনায় প্রাথমিকভাবে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে তদন্ত করা হবে। দক্ষ চিকিৎসক ছাড়া ভুল অস্ত্রোপচারের কারণে রোগীর মৃত্যু ঘটলে সেই ক্লিনিকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। লাইসেন্স ছাড়াই ক্লিনিক পরিচানার বিষয়ে তিনি জানান, এ বিষয়েও তদন্ত করা হবে।

সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু তাহের মো. সামসুজ্জামান জানান, জনস্বার্থে ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে ক্লিনিকগুলোতে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। অভিজ্ঞ চিকিৎসক ছাড়া ক্লিনিক ম্যানেজার দিয়ে অস্ত্রোপচার করার অভিযোগ পেলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

ঠাকুরগাঁও সদর পৌরসভা সরকারপাড়ায় অবস্থিত একতা নার্সিং হোম নামে এই বেসরকারি ক্লিনিকটি ২০১৮ সাল থেকে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। বর্তমানে এই ক্লিনিকটি সরকারের অনুমতি (লাইসেন্স) ছাড়াই পরিচালিত হচ্ছে। স্বাস্থ্য বিভাগের নজরদারি ও জবাবদিহিতা না থাকায় এখানে চিকিৎসা নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ।


Publisher & Editor :Md. Abu Hena Mostafa Zaman

Mobile No: 01971- 007766; 01711-954647

Head office: 152- Aktroy more ( kazla)-6204  Thana : Motihar,Rajshahi
Email : [email protected], [email protected]