ডিসি পদে বড় পরিবর্তন শিগগিরই, প্রথম দফায় ঢাকা খুলনা রংপুর ময়মনসিংহ কুমিল্লা ফরিদপুরসহ ১৫-২০ জেলায় নতুন মুখ, তালিকার অধিকাংশই মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী সচিবদের পিএস ও গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে কর্মরত
প্রশাসনে বড় পরিবর্তন আনা হচ্ছে। ঢেলে সাজানো হচ্ছে মাঠপ্রশাসনসহ কেন্দ্রীয় প্রশাসন। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় এবং বিভাগের সচিব পদে পরিবর্তন আনা হবে। এরপর পর্যায়ক্রমে বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পদেও রদবদল আনা হবে। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে শিগগিরই মাঠপ্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ডিসি পদে বড় ধরনের পরিবর্তন করা হচ্ছে। প্রথম দফায় ঢাকা, খুলনা, রংপুর, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, ফরিদপুরসহ কমবেশি ১৫ থেকে ২০ জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগ দেওয়া হবে। আর এসব পদে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তারাই আগামী জাতীয় নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন। তা মাথায় রেখে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে ক্ষমতাসীন দলের প্রতি ‘কমিটেড’ কর্মকর্তাদেরই এসব পদে বদলি-পদায়ন করা হবে। এ প্রক্রিয়ায় যাতে বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত কোনো কর্মকর্তা নিয়োগ না পান সে ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে সংশ্লিষ্টদের। ২ নভেম্বর উপসচিব থেকে যুগ্মসচিব পদে ১৭৯ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিয়েছে সরকার। এর মধ্যে ঢাকা, খুলনা, গোপালগঞ্জ, রংপুর, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, ফরিদপুর, কক্সবাজার, টাঙ্গাইল, খাগড়াছড়ি, ঝালকাঠি, সিরাজগঞ্জ ও লালমনিরহাটের ডিসিরাও রয়েছেন। পদোন্নতি পাওয়া এই ডিসিদের পাশাপাশি আরও তিন-চারটি জেলার ডিসিকে প্রত্যাহার করে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে পদায়ন করা হবে। সেখানে বিসিএস ২৪ ও ২৫তম ব্যাচের কর্মকর্তার সমন্বয়ে তৈরি করা ডিসি ফিটলিস্ট থেকে যোগ্য কর্মকর্তাদের নিয়োগ করা হবে। এ নিয়ে শেষ সময়ের কাজ চলছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে। চলতি বা আগামী সপ্তাহেই এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি হতে পারে। এ ধাপে ডিসি ফিটলিস্ট থেকে ২৪তম বিসিএসের ১০ থেকে ১২ জন এবং ২৫তম বিসিএসের তিন থেকে পাঁচ জন কর্মকর্তা ডিসি হিসেবে নিয়োগ পেতে পারেন। বর্তমান ডিসিদের মধ্য থেকে কাউকে কাউকে ঢাকা ও খুলনার মতো বড় জেলাগুলোয় বদলি করা হতে পারে। তবে এসব জেলায় নতুন কাউকে পদায়ন করা হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। ইতোমধ্যে এসব কর্মকর্তার জীবনবৃত্তান্ত যাচাই-বাছাই করা হয়েছে। এর মধ্যে যারা ছাত্রজীবনে সরকারদলীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন তাদের প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। তালিকায় থাকা কর্মকর্তার অধিকাংশই বর্তমান সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর একান্ত সচিব ও গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে কর্মরত।
তবে এবার ডিসি নিয়োগের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টরা খুবই সতর্ক। কারণ চলতি বছর ৫ জানুয়ারি ১১ উপসচিবকে বিভিন্ন জেলায় ডিসি হিসেবে নিয়োগের পর ‘ছাত্রদল-সংশ্লিষ্টতার’ অভিযোগে তৎকালীন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের শৃঙ্খলা-৪ শাখার উপসচিব নাফিসা আরেফীনের নিয়োগ বাতিল করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তাকে নীলফামারীতে ডিসি পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। এর আগে ২০২০ সালের জুলাইয়ে মেহেরপুরে ডিসি পদে নিয়োগ পাওয়ার পর ছাত্রদল-সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের উপসচিব মো. শহিদুল ইসলামকেও পদায়ন করা হয়নি। এ ঘটনাগুলো বিবেচনায় নিয়ে ডিসি নিয়োগের জন্য প্রস্তাব পাঠাতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে কঠোর বার্তা দিয়েছে সরকারের শীর্ষ মহল। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডিসিরা নির্বাচনের সময় জেলা রিটার্নিং অফিসারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। যে-কোনো কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ থেকে শুরু করে বাতিল করার ক্ষমতা ডিসির হাতে ন্যস্ত থাকে। সশস্ত্র বাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সব বাহিনী থাকে রিটার্নিং কর্মকর্তা তথা ডিসিদের অধীনে। স্বাভাবিক সময়ে পুলিশ বাহিনী জেলায় স্বাধীনভাবে কাজ করলেও নির্বাচনের সময় তারা ডিসির কর্তৃত্ব মেনে চলে। ডিসিরা নির্বাচনের সময় সমন্বয়কারীর ভূমিকা পালন করেন। এসব কারণে সব সরকারই তাদের নিজস্ব ছক অনুযায়ী নির্বাচনকালীন প্রশাসন সাজিয়ে থাকে। একান্ত অনুগত ও বিশ্বস্ত কর্মকর্তাদের এ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। কর্মকর্তারা বলছেন, যারা মাঠ প্রশাসনে কাজ করেছেন তাদের জন্য ডিসির পদটি খুবই কাক্সিক্ষত। দীর্ঘদিন ধরে ফিটলিস্ট তৈরিতে কর্মকর্তাদের ব্যাপারে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো খবর নিচ্ছিল। বিশেষ করে ব্যক্তি ও পরিবারকেন্দ্রিক রাজনৈতিক-সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি এবার খুব কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। কর্মকর্তারা ছাত্রজীবনে কোন সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন সে বিষয়টিও সূক্ষ্মভাবে তদন্ত করা হয়েছে। নিরপেক্ষ কর্মকর্তারা নিজেদের অবস্থান বদলাতে সময় নেন না। তাই তাদের ওপর ভরসা করতে চায় না সরকার। এবারের ডিসি ফিটলিস্টে নিরপেক্ষ কর্মকর্তাদের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা তাই ক্ষীণ। এদিকে ডিসেম্বরের মধ্যে নিয়মিত চাকরি শেষে ছয়জন সচিব অবসরে যাচ্ছেন। এ সময়ের মধ্যে চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবেরও। ফলে প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ দুটি পদসহ ছয় মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পদ খালি হচ্ছে। এসব পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেতে ইতোমধ্যে কেউ কেউ দেনদরবার শুরু করেছেন বলে আভাস মিলেছে। তবে দেনদরবার ফলপ্রসূ হবে কি না তা নির্ভর করছে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার ওপর। চুক্তিভিত্তিক না হলে নিয়মিত ব্যাচ হিসেবে বিসিএস অষ্টম (১৯৮৬), নবম, দশম, একাদশ ও ত্রয়োদশ ব্যাচের উপযুক্ত কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া হবে। সেমতে প্রশাসনের শীর্ষ পদ এবং গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিব পদে নিয়োগ দেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে চাকরিজীবনের যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত এবং গ্রামের বাড়িসহ স্বজনদের রাজনৈতিক পরিচয়েরও (যদি থাকে) খবর নেওয়া হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে ছাত্রজীবনে ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ দফতরগুলোয় বদলি-পদায়ন করা হবে।