জুমার প্রথম খুতবা: বিনয় ও নম্রতার গুরুত্ব


ধর্ম ডেস্ক , আপডেট করা হয়েছে : 04-11-2022

জুমার প্রথম খুতবা: বিনয় ও নম্রতার গুরুত্ব

আজ শুক্রবার। জুমার দিন। ৪ নভেম্বর ২০২২ ইংরেজি, ১৯ কার্তিক ১৪২৯ বাংলা, ০৮ রবিউস সানি ১৪৪৪ হিজরি। আজ রবিউস সানি মাসের দ্বিতীয় জুমা। আজকের জুমার আলোচ্য বিষয়- মানুষের জীবনে বিনয় ও নম্রতার গুরুত্ব। আল্লাহ তাআলা কোরআনুল কারিমের অনেক স্থানে বিনয় নম্রতা ও কোমলার কথা বলেছেন। এগুলো নবুয়তি গুণ। এ গুণগুলো ছিলো নবি-রাসুলদের গুণ। তাহলে কোরআন সুন্নাহতে বিনয় নম্রতা ও কোমলা প্রসঙ্গে কী দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে?

আলহামদুলিল্লাহ! সব প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি একক, তার কোনো অংশীদার নেই। যিনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক। যার পরে আর কোনো নবি নেই। এরপর আল্লাহ তাআলা নবিজিকে উদ্দেশ্য করে বিনয় নম্রতা ও কোমলার উপকারিতার কথা তুলে ধরে ঘোষণা করেন-

فَبِمَا رَحۡمَۃٍ مِّنَ اللّٰهِ لِنۡتَ لَهُمۡ ۚ وَ لَوۡ کُنۡتَ فَظًّا غَلِیۡظَ الۡقَلۡبِ لَانۡفَضُّوۡا مِنۡ حَوۡلِکَ ۪ فَاعۡفُ عَنۡهُمۡ وَ اسۡتَغۡفِرۡ لَهُمۡ وَ شَاوِرۡهُمۡ فِی الۡاَمۡرِ ۚ فَاِذَا عَزَمۡتَ فَتَوَکَّلۡ عَلَی اللّٰهِ ؕ اِنَّ اللّٰهَ یُحِبُّ الۡمُتَوَکِّلِیۡنَ

‘আল্লাহর রহমতে তুমি তাদের প্রতি বিনয়, নম্র ও কোমল হৃদয় হয়েছিলে; যদি তুমি রূঢ় ও কঠোরচিত্ত ও রুক্ষ হতে, তবে তারা তোমার আশপাশ থেকে সরে পড়তো। সুতরাং তুমি তাদের ক্ষমা করো এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো এবং কাজকর্মে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করো।’ (সুরা আলে ইমরান : আয়াত ১৫৯)

বিনয় নম্রতা ও কোমলতা মানুষের অন্যতম চারিত্রিক গুণ। এ গুণের কারণে মানুষ সব সময় অন্যের কাছে প্রশংসনীয় হয়। শুধু মানুষই বিনয়ের প্রশংসা করেনি, পবিত্র ধর্ম ইসলামে ওঠে এসেছে বিনয় ও নম্রতার সৌন্দর্য, গুরুত্ব ও মর্যাদা। হাদিসে পাকে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিনয়ের চমৎকার উপদেশ দিয়েছেন। কী সেসব উপদেশ?

বিনয় মানুষের একটি বিশেষ গুণ। এটি নবুয়তি গুণও বটে। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও বিনয়ী ছিলেন। তিনি সব সময় ধর্ম-বর্ণ, জাতি-গোষ্ঠী, মুসলিম-অমুসলিম, দলমত নির্বিশেষে সব মানুষের সঙ্গে বিনয়ের সঙ্গে নম্র আচরণ করতেন। হাসিমুখে কথা বলতেন। তাঁর এমন আচরণের কথা ওঠে এসেছে কোরআনে বর্ণনায়-

فَبِمَا رَحۡمَۃٍ مِّنَ اللّٰهِ لِنۡتَ لَهُمۡ ۚ وَ لَوۡ کُنۡتَ فَظًّا غَلِیۡظَ الۡقَلۡبِ لَانۡفَضُّوۡا مِنۡ حَوۡلِکَ ۪ فَاعۡفُ عَنۡهُمۡ وَ اسۡتَغۡفِرۡ لَهُمۡ وَ شَاوِرۡهُمۡ فِی الۡاَمۡرِ ۚ فَاِذَا عَزَمۡتَ فَتَوَکَّلۡ عَلَی اللّٰهِ ؕ اِنَّ اللّٰهَ یُحِبُّ الۡمُتَوَکِّلِیۡنَ

‘আল্লাহর রহমতে তুমি তাদের প্রতি বিনয়, নম্র ও কোমল হৃদয় হয়েছিলে; যদি তুমি রূঢ় ও কঠোরচিত্ত ও রুক্ষ হতে, তবে তারা তোমার আশপাশ থেকে সরে পড়তো। সুতরাং তুমি তাদের ক্ষমা করো এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো এবং কাজকর্মে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করো।’ (সুরা আলে ইমরান : আয়াত ১৫৯)

হজরত আয়েশার প্রতি নম্রতা-কোমলতার উপদেশ

হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-

إِنَّ اللَّهَ تَعَالَى رَفِيقٌ يُحِبُّ الرِّفْقَ وَيُعْطِي عَلَى الرِّفْقِ مَا لَا يُعْطِي عَلَى الْعُنْفِ وَمَا لَا يُعْطِي عَلَى مَا سِوَاهُ

‘ আল্লাহ তাআলা নিজে কোমল, তিনি কোমলতাকে ভালোবাসেন। আর তিনি কোমলতার প্রতি যত অনুগ্রহ করেন, কঠোরতা এবং অন্য কোনো আচরণের প্রতি তত অনুগ্রহ করেন না।’ (মুসলিম ২৫৯৩, আবু দাউদ ৪৮০৭, ইবনে মাজাহ ৩৬৮৮

হাদিস গ্রন্থ মুসলিমের অপর এক বর্ণনায় এসেছে, একদিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে বললেন-

عَلَيْكِ بِالرِّفْقِ وَإِيَّاكِ وَالْعُنْفَ وَالْفُحْشَ إِنَّ الرِّفْقَ لَا يَكُونُ فِي شَيْءٍ إِلَّا زَانَهُ وَلَا يُنْزَعُ مِنْ شَيْء إِلَّا شانه

‘কোমলতাকে নিজের জন্য বাধ্যতামূলক করে নাও এবং কঠোরতা ও নির্লজ্জতা থেকে নিজেকে রক্ষা করো। কেননা যে জিনিসের মধ্যে নম্রতা ও কোমলতা থাকে সে নম্রতা ও কোমলতাই তার সৌন্দর্য বৃদ্ধির কারণ হয়। আর যে জিনিসে বিনয়-নম্রতা ও কোমলতা থাকে না তা দোষণীয় হয়ে পড়ে।’ (মিশকাত ৫০৬৮)

বিনয়-নম্রতা ও কোমলতাকে মুমিনের অপরিহার্য গুণ হিসেবে বিবেচনা করে ইসলাম। কারণ একজন মানুষের মধ্যে যতক্ষণ পর্যন্ত বিনয়, নম্রতা ও কোমলতা না থাকবে, ততক্ষণ সে আল্লাহর গোলামি করতে পারবে না। আল্লাহর একনিষ্ঠ গোলামির জন্য বিনয়, নম্রতা ও কোমলতা অপরিহার্য শর্ত। এ কারণেই মহান আল্লাহ তাআলা কোরআনুল কারিমে ঘোষণা করেন-

وَ عِبَادُ الرَّحۡمٰنِ الَّذِیۡنَ یَمۡشُوۡنَ عَلَی الۡاَرۡضِ هَوۡنًا وَّ اِذَا خَاطَبَهُمُ الۡجٰهِلُوۡنَ قَالُوۡا سَلٰمًا

‘আর রহমানের বান্দা তারাই যারা পৃথিবীতে কোমল-নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং অজ্ঞ লোকেরা যখন তাদেরকে সম্বোধন করে তখন তারা বলে ‘সালাম’।’ (সুরা ফোরকান : আয়াত ৬৩

নবি-রাসুলদের বিনয়ী হওয়ার দৃষ্টান্ত

কোরআনের বর্ণনায় নবি-রাসুলদের বিনয়ী নম্রতা ও কোমলতা প্রকাশ করার অনেক ঘটনা রয়েছে। কোমলতা ও বিনয় নবিদের গুণ। পক্ষান্তরে অহঙ্কার ও কঠোরতা হলো শয়তানের বৈশিষ্ট্য। নবি-রাসুলগণ তাদের জীবনে কোমলতা ও বিনয়ের দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। যেমন-

হজরত আদম আলাইহিস সালামের বিনয়

তিনি পৃথিবীর প্রথম মানব। আল্লাহর নির্দেশ ভঙ্গ করার পর আল্লাহর প্রশ্নের মুখে তিনি অহঙ্কার না করে বরং পুরোপুরি বিনয় ও কোমলভাবে আল্লাহর কাছে নিজের দোষ স্বীকার করে বলেছেন-

رَبَّنَا ظَلَمۡنَاۤ اَنۡفُسَنَا وَ اِنۡ لَّمۡ تَغۡفِرۡ لَنَا وَ تَرۡحَمۡنَا لَنَکُوۡنَنَّ مِنَ الۡخٰسِرِیۡنَ

উচ্চারণ : ‘রাব্বানা জালামনা আংফুসানা ওয়া ইল লাম তাগফিরলানা ওয়া তারহামনা লানাকুনান্না মিনাল খাসিরিন।’

হে আমাদের রব! আমরা নিজেদের ওপর জুলুম করেছি, আপনি ক্ষমা ও দয়া না করলে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হবো।’ (সুরা আরাফ : আয়াত ২৩)

হজরত নুহ আলাইহি সালামের বিনয় ও নম্রতা

তিনি আল্লাহর রাসুল ছিলেন। নিজের কাফের ছেলের পক্ষে আল্লাহর কাছে সুপারিশ করতে চাইলে আল্লাহ তাআলা তাকে সাবধান করে দেন। তখন নুহ আলাইহিস সালাম বিনয় ও নম্রতার সঙ্গে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে নেন এভাবে-

رَبِّ اِنِّیۡۤ اَعُوۡذُ بِکَ اَنۡ اَسۡـَٔلَکَ مَا لَـیۡسَ لِیۡ بِهٖ عِلۡمٌ ؕ وَ اِلَّا تَغۡفِرۡ لِیۡ وَ تَرۡحَمۡنِیۡۤ اَکُنۡ مِّنَ الۡخٰسِرِیۡنَ

উচ্চারণ: রাব্বি ইন্নি আউজুবিকা আন্ আস্আলাকা মা-লাইসা লি বিহি ইলমুন; ওয়া ইল্লা তাগফিরলি ওয়া তারহামনি আকুম মিনাল খাসিরিন।

অর্থ : হে প্রভু! যে বিষয়ে আমার জ্ঞান নেই; সে বিষয়ে চাওয়া থেকে তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। তুমি যদি আমাকে ক্ষমা না করো, দয়া না করো; তাহলে আমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তরর্ভূক্ত হয়ে যাবো। (সুরা হুদ : আয়াত ৪৭)

ইজরত ইউনুস আলাইহিস সালামের বিনয়

হজরত ইউনুস আলাইহিস সালামের ঘটনা প্রায় সবাই জানে। নিজের অপরাধের জন্য তাঁকে মাছের পেটে যেতে হয়েছে, অন্ধকার মাছের পেটে থাকতে হয়েছে। সে সময় তিনি আল্লাহর কাছে বিনয় ও নম্রতা প্রকাশ করেছিলেন। সেখান থেকেই তিনি আল্লাহর কাছে বিনয় ও নম্রতা সঙ্গে বলেছেন-

فَنَادٰی فِی الظُّلُمٰتِ اَنۡ لَّاۤ اِلٰهَ اِلَّاۤ اَنۡتَ سُبۡحٰنَکَ ٭ۖ اِنِّیۡ کُنۡتُ مِنَ الظّٰلِمِیۡنَ

উচ্চারণ : ... ‘লা ইলাহা ইল্লাহ আংতা সুবহানাকা ইন্নি কুংতু মিনাজ জ্বালিমিন।’

অর্থ : তারপর সে অন্ধকার থেকে ডেকে বলেছিল, ‘আপনি ছাড়া কোনো (সত্য) ইলাহ নেই। আপনি পবিত্র মহান। নিশ্চয়ই আমি ছিলাম জালিম।’ (সুরা আম্বিয়া : আয়াত ৮৭)

হজরত মুসা আলাইহিস সালামের বিনয়ী ডাক

মুসা আলাইহিস সালাম যখন অনিচ্ছাকৃতভাবে একজন লোককে হত্যা করেছিল, তখন নিজের সবটুকু বিনয় ও নম্রতা দিয়ে ক্ষমার জন্য মহান আল্লাহকে এমনভাবে ডেকেছিলেন, যার ফলে আল্লাহ তার ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন। তা ছিল এমন-

رَبِّ اِنِّیۡ ظَلَمۡتُ نَفۡسِیۡ فَاغۡفِرۡ لِیۡ

উচ্চারণ : ‘রাব্বি ইন্নি জ্বালামতু নাফসি ফাগফিরলি’

অর্থ : ‘হে আমার রব! নিশ্চয়ই আমি আমার নফসের প্রতি জুলুম করেছি, সুতরাং আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন।’

হজরত মুসা আলাইহিস সালামের এ বিনয়ী ক্ষমার আহ্বানের পর মহান আল্লাহ ঘোষণা দেন-

فَغَفَرَ لَهٗ ؕ اِنَّهٗ هُوَ الۡغَفُوۡرُ الرَّحِیۡمُ

‘এরপর তিনি তাকে ক্ষমা করলেন। নিশ্চয়ই তিনি অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা কাসাস : আয়াত ১৬)

এভাবেই নবীগণ যখনই ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় সামান্য ভুল করে ফেলেছেন, সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর কাছে বিনয় ও কোমলতার সঙ্গে ক্ষমা চেয়েছেন; নিজেদের ভুলের পক্ষে কোনো যুক্তি প্রদর্শন করেননি; যেমনটি করেছিল শয়তান।

সুতরাং মানুষের উচিত, কোমল হওয়া। কোমলতার গুণে নিজেদের গড়া। কেননা মহান আল্লাহর কোমল। তিনি কোমলতাকে ভালোবাসেন। আর সব নবি-রাসুল ও আল্লাহর প্রিয় বান্দাগণও ছিলেন কোমল। তাই দুনিয়ার প্রতিটি কাজে বিনয়ী হওয়া।

মানুষের সঙ্গে সর্বাবস্থায় বিনয়ী, নম্র ও কোমলতা প্রকাশ করা। নবুয়তি গুণের প্রকাশ ঘটানো। আর তাকে ফুটে ওঠবে ইসলামে সুমহান সৌন্দর্য। বিনয় নম্রতা ও কোমলতা প্রকাশ করলে কোরআন-সুন্নাহর বাস্তবায়ন প্রতিফলিত হবে। মুসলিমরাই হবে বিজয়ী।

আল্লাহ তাআলা সবাইকে বেশি বেশি বিনয় নম্রতা ও কোমলতার আমল করার তাওফিক দান করুন। নিজেদের মধ্যে নবুয়তি গুণের বাস্তবায়ন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।


Publisher & Editor :Md. Abu Hena Mostafa Zaman

Mobile No: 01971- 007766; 01711-954647

Head office: 152- Aktroy more ( kazla)-6204  Thana : Motihar,Rajshahi
Email : [email protected], [email protected]