রাজশাহীতে হিমাগারের আলুতে পচন, লোকসানে চাষিরা


নিজস্ব প্রতিবেদক , আপডেট করা হয়েছে : 01-11-2022

রাজশাহীতে হিমাগারের আলুতে পচন, লোকসানে চাষিরা

রাজশাহীর আলুচাষি ও ব্যবসায়ীরা অনেকাংশে হিমাগার মালিকদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। প্রতিবছরই হিমাগার মালিকরা বিভিন্ন অজুহাতে ভাড়া বাড়ালেও সেবার মান একেবারে শূন্য। চুক্তিনামা ছাড়াই একটি রশিদে কোটি কোটি টাকার আলু রাখতে হচ্ছে তাদের। রক্ষিত আলুতে গাছ গজালে, আলু পচে গেলে, ওজন কমে গেলে হিমাগার কর্তৃপক্ষ দায় এড়িয়ে যান। এবারেরও বিভিন্ন হিমাগারে ব্যাপক আলুতে পচন ও শেকড় গজিয়েছে। হিমাগার কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনার কারণেই এসব ঘটে থাকে বলে দাবি করেছেন আলুচাষি ও ব্যবসায়ীরা।

বর্তমানে আলুর দামে বড় ধরনে দরপতন, পুঁজি হারাতে বসেছেন রাজশাহীর আলুচাষি ও ব্যবসায়ীরা। হিমাগারে আলু মজুত করে বিপাকে পড়েছেন তারা। বাজারে অন্য সবজির দাম বেশি হলেও তুলনামূলকভাবে আলুর দাম অনেক কম। ফলে লোকসান গুনতে হচ্ছে চাষি ও ব্যবসায়ীদের। গত বছরও হিমাগারে আলু রেখে লোকসান গুনেছিলেন চাষি ও ব্যবসায়ীরা।

আলুচাষিদের দাবি, উৎপাদন ও হিমাগারে সংরক্ষণের খরচের হিসাবে প্রতি কেজি আলুতে লোকসান হচ্ছে চার থেকে পাঁচ টাকা। চাষিরা আলু বিক্রির জন্য হিমাগারে অপেক্ষা করলেও ক্রেতা পাচ্ছেন না। চাষি ও ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, বাজারে আলুর চাহিদা আছে। কিন্তু সিন্ডিকেটের কারণে আলুর দাম পাচ্ছেন না তারা। অথচ প্রতিবছরই বিভিন্ন অজুহাতে একদিকে বস্তার আলুর ওজন কমানো এবং অন্যদিকে ভাড়া বাড়ানো স্বভাবে পরিণত হচ্ছে মালিকদের। হিমাগার মালিকরা ব্যবসায়ী ও সফল চাষিদের মতামত না নিয়েই একতরফাভাবে ভাড়া বাড়িয়ে যাচ্ছেন। সরকার বা কোন পক্ষের দেখভাল না থাকার কারণে মালিকপক্ষ ইচ্ছামত চাষিদের শোষণ করে চলেছেন বরাবরেই অভিযোগ আছে চাষিদের।

আলু ব্যবসায়ীরা বলেন, এ বছর প্রথম দিকে আলুর দাম ছিল ২২ থেকে ২৪ টাকা কেজি। বছরের প্রথম দিকে যারা আলু বিক্রি করেছেন, তাদের মধ্যে হাতে গোনা কিছু ব্যবসায়ী সামান্য লাভের মুখ দেখেছেন। বাকিরা এখন পর্যন্ত লোকসানের মধ্যে রয়েছেন। রাজশাহীতে বর্তমানে অর্থকরি ফসল বলতেই আলু। বিভিন্ন উপজেলার কয়েকজন বাণিজ্যিক আলুচাষির সাথে কথা বলে জানা গেছে, মৌসুমের শুরুতে হিমাগারে সংরক্ষণের সময় আলুর যে দাম ছিল বর্তমানে বস্তা প্রতি দাম ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা কমে গেছে। মার্চে আলু হিমাগারে মজুত রেখে সেপ্টেম্বর থেকে বের করা শুরু হয়। অক্টোবর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত চলে আলু আবাদের মৌসুম। ছয় মাসের জন্য হিমাগারে আলু রাখা হয় ভাড়ার বিনিময়ে। চাষিরা আলু বিক্রি করে হিমাগারের ভাড়া পরিশোধ করেন এবং লাভসহ পুঁজিও তুলে নেন। কিন্তু গত বছর থেকে আলুর দামে বিপর্যয় চলছে। গতবছরও বেশীরভাগ চাষি ও ব্যবসায়ীরা বস্তা প্রতি ২০০ টাকা থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত লোকসান গুনেছেন আলু বিক্রি না হওয়ায়। বিপুল পরিমাণ আলু হিমাগারগুলোতে পড়ে থেকে নষ্ট হয়েছে।

রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার মৌগাছি নন্দনহাট গ্রামের আলুচাষি আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘বিক্রির জন্য সোমবার আমান এগ্রো হিমাগারে রক্ষিত ১শ’ আলু বস্তা বের করি। আলুর বস্তা ঢেলে হতবাক হয়ে যায়। প্রতিটি আলুতেই ব্যাপকভাবে শিকড় গজিয়েছে। পাশাপাশি আলুতে দাগ পড়েছে এবং কুচকে গেছে। যা বাজারে বর্তমান দামের অর্ধেকেই বিক্রি করা যাবে না। একে তো দাম কম। এরপরেও পচন ও শেকড় গজানোর জন্য আমার মত অনেক চাষি ব্যাপক লোকসানে পড়েছে’। তিনি দাবি করেন হিমাগারের অব্যবস্থাপনার জন্য এমন ঘটেছে। তিনি বলেন, ঠিকভাবে বাতাস না দিলে, কিছুদিন পরপর আলুর বস্তায় পালট না দিলে (ওলট-পালট), নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ না থাকলে-এমন হয়। আমাদের অনেকটা জিম্মি করে হিমাগার মালিকরা অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে।

আলুচাষি ও আলু ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা কৃষকদের সঙ্গে সব সময় একাত্মতা পোষণ করেছি। কৃষকদের সমস্যার সমাধান হওয়া দরকার। কৃষকরা আলু উৎপাদন করে আর হিমাগার সেটা পচিয়ে ফেলে হাত গুটিয়ে বসে থাকবে, তা হতে পারে না।’

তিনি আরো বলেন, হিমাগারে রাখা আলু পচে গেলে বা আলুতে গাছ গজালে কৃষকের ক্ষতিপূরণ না পেলে আইনের আশ্রয় নিতে হবে। হিমাগার কর্তৃপক্ষের নির্ধারণ করে দেয়া ভাড়া কমানোর দাবিতে আমরা বারবার বলে এসেছি। কিন্তু তারা কমাননি। এত বেশি ভাড়া দিয়েও কৃষক ও ব্যবসায়ীর আমানত রক্ষা করতে পারেননি তারা। প্রত্যেকটি হিমাগারেই আলু পচেছে। এর দায় হিমাগার কর্তৃপক্ষকে নিতে হবে।

এব্যাপারে আমান এগ্রো’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল খালেক জানান, বিভিন্ন কারণে আলু পচে বা শেকড় গজাতে পারে। যেমন- আলু উঠানোর সময় প্রচন্ড তাপমাত্রা থাকলে, রোদে আলু রেখে দিলে, ধারনক্ষমতার অতিরিক্ত আলু রাখলে, বিদ্যুৎ ঘাটতি থাকলে। এছাড়াও বর্তমানে চাষিরা আলুর ফলন বাড়ানোর জন্য জমিতে এক জাতীয় ট্যাবলেট ব্যবহার করছে। এ কারণেও আলু পচে বা শেকড় গজাতে পারে। তবে বিষয়টি ক্ষতিয়ে দেখা হচ্ছে।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোজদার হোসেন বলেন, এবার বিক্রির ভরা মৌসুমেও আলুর দাম কিছুটা কম। কৃষি বিভাগ উৎপাদনের ওপর নজর দেয়। উৎপাদিত পন্যের দাম কি হবে এর জন্য সরকার কর্মকর্তা রেখেছেন। বাজার মনিটরিং কর্মকর্তাগণ সেটা দেখভাল করেন। তবে হিমাগারে আলু পচে যাওয়া, শেকড় গজানো এবং চাষি ও ব্যবসায়ীদের লোকসান হলে আগামীতে আলু আবাদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

রাজশাহী হিমাগার মালিক সমিতির সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহীতে মোট ৩৬টি হিমাগার রয়েছে। এসব হিমাগারে প্রায় ৮২ লাখ বস্তায় ৪ লাখ ২৫ হাজার টন আলু সংরক্ষণ করা হয়েছিল। প্রতি হিমাগারেই এখনও ৩০ থেকে ৪০ ভাগ আলু মজুত রয়েছে। হিমাগার মালিকদের সাথে চুক্তি অনুযায়ী চাষিদের এই বিপুল পরিমাণ আলু তুলে নিতে হবে ১৫ নভেম্বরের মধ্যে। কোনো চাষি আলু উত্তোলনে সক্ষম না হলে তাকে হিমাগারের বাড়তি ভাড়া গুনতে হবে।


Publisher & Editor :Md. Abu Hena Mostafa Zaman

Mobile No: 01971- 007766; 01711-954647

Head office: 152- Aktroy more ( kazla)-6204  Thana : Motihar,Rajshahi
Email : [email protected], [email protected]