মাছ ও ভাতের সঙ্গে বাঙালির সম্পর্ক বহুকালের। তবে বাঙালি ঠিক কবে থেকে মাছ খাওয়া শুরু করল তার কোনো সঠিক দিনক্ষণ পাওয়া না গেলেও বাংলায় যত নদী-নালা-খাল-বিল ছিল, তাতে ধারণা করা যায় যে আদিকাল থেকেই মাছ খেতো বাঙালি। শুধু বাংলাদেশই নয়, পৃথিবীর সব প্রান্তেই সম্ভবত মাছপ্রেমী আছে, মাছ দিয়ে অতিথি আপ্যায়নের রেওয়াজ আছে। পবিত্র হাদিসের তথ্য মতে পরকালে জান্নাতিদেরও প্রথম আপ্যায়নে মাছের কলিজা দিয়ে নাশতা দেওয়া হবে।
সাওবান (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিস থেকে জানা যায়, একবার এক ইহুদি রাসুল (সা.)-কে কিছু প্রশ্ন করেছিল, তন্মধ্যে একটি হলো, জান্নাতে প্রবেশ করার পর জান্নাতিদের সর্বপ্রথম কী দিয়ে আপ্যায়ন করা হবে? তিনি বলেন, মাছের কলিজা। ইহুদি পুনরায় প্রশ্ন করল, এরপর তাদের কী খাবার পরিবেশন করা হবে? তিনি বলেন, তাদের জন্য জান্নাতে পালিত ষাঁড় জবাই করা হবে। ইহুদি আবার প্রশ্ন করল, এরপর এদের পানীয় কী হবে? রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, সালসাবিল নামক ঝরনার পানি। অতঃপর সে বলল, আপনি সত্য বলেছেন। (মুসলিম, হাদিস : ৬০৩)
মাছ আমাদের প্রতিদিনের খাদ্যতালিকার অন্যতম ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আমাদের দেহের পুষ্টির জোগান দিতেও মাছের অবদান রয়েছে। কিন্তু কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর কারণে এই মাছই হয়ে ওঠে মরণফাঁদ। এটা গোটা জাতির জন্য এক উদ্বেগের বিষয়। গণমাধ্যমের বিভিন্ন খবর থেকে জানা যায়, মাছকে আকর্ষণীয় ও তরতাজা দেখানোর জন্য কিছু অসাধু ব্যবসায়ী তাতে ঢেঁড়সের রস, কাপড়ের রং আর ফরমালিন মিশিয়ে থাকে, যা শরীরের জন্য ভীষণ ক্ষতিকর।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যেকোনো ধরনের রং হচ্ছে কেমিক্যাল। এটি মানুষের শরীরে প্রবেশ করলে পাকস্থলী, লিভার, কিডনিসহ বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। এমনকি ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। আর ফরমালিন মেশানো ফল বা মাছ-মাংস অনেক দিন ধরে খেলে লিভার ক্যান্সার, হার্টের অসুখ এবং কিডনি নষ্ট হতে পারে। তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে ফরমালিনযুক্ত খাবার খেলে বমি বমি ভাব দেখা দেয়।
তাই যারা মাছে ফরমালিন ও কৃত্রিম রং মিশিয়ে বাড়তি মুনাফা আদায় করছে, তারা নিজেদেরই ক্ষতি করছে। এর কারণে তাদের ইহকাল-পরকাল ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
অবৈধ পন্থায় উপার্জনের কারণে তাদের রিজিকের বরকত যেমন উঠে যাবে, তেমনি তারা যতই উপার্জন করুক বরকত অনুভব করবে না, বরং বিভিন্ন বিপদে জর্জরিত থাকবে। রাসুল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি সংগত পন্থায় সম্পদ অর্জন করে তাকে বরকত দান করা হয়। আর যে ব্যক্তি অসংগত পন্থায় সম্পদ অর্জন করে সে এমন ব্যক্তির ন্যায় যে আহার করে কিন্তু তৃপ্ত হয় না। (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩৯৯৫)
এমনকি মুমিনের খাতা থেকেও তাদের নাম কাটা যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যার জিহ্বা ও হাত থেকে মুসলিমগণ নিরাপদ থাকে সে ব্যক্তিই প্রকৃত মুসলিম। আর যাকে মানুষ তাদের জান ও মালের জন্য নিরাপদ মনে করে সে-ই প্রকৃত মুমিন। ’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৬২৭)
তা ছাড়া নিরাপদ খাদ্য জনগণের অধিকার। এই অধিকার রক্ষার জন্য প্রিয় নবী (সা.) নিজেই বাজার তদারক করেছেন বলে হাদিসে পাওয়া যায়। এবং যারা খাদ্যে ভেজাল মেশায় নবীজি (সা.) তাদের নিজের উম্মত বলে স্বীকার করেন না বলে ঘোষণা দিয়েছেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) এমন এক ব্যক্তির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, যে খাদ্যদ্রব্য বিক্রি করছিল। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কিভাবে বিক্রি করছ? তখন সে তাঁকে এ সম্পর্কে জানাল। ইতিমধ্যে তিনি এ মর্মে ওহিপ্রাপ্ত হলেন, আপনি আপনার হাত শস্যের স্তূপের ভেতরে ঢোকান। তিনি স্তূপের ভেতরে তাঁর হাত ঢুকিয়ে অনুভব করলেন যে তার ভেতরের অংশ ভিজা। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি প্রতারণা করে তার সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। (আবু দাউদ, হাদিস : ৩৪৫২)
অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘অভিশপ্ত সে, যে কোনো মুমিনের ক্ষতি করে অথবা তার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে। ’ (তিরমিজি, হাদিস : ১৯৪০)
যারা খাবারে ভেজাল মেশায় তারাও তো প্রতিটি ক্রেতা ও তাদের পরিবার-পরিজনের ক্ষতি করছে। অতএব আমাদের উচিত সামান্য লাভের আশায় নিজেদের দুনিয়া-আখিরাত ধ্বংস না করা।