ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্যদিয়ে দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে অনুুষ্ঠিত হলো গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী তন্ত্র-মন্ত্রের ‘পাতা খেলা’। কড়াই যুব সমাজের উদ্যোগে গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে উপজেলার কাজীহাল ইউনিয়নের পুখুরী স্কুল এ- কলেজ মাঠে এই খেলাটি অনুষ্ঠিত হয়।
এ খেলাটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধান অতিথি হিসেবে উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও সমাজসেবক মো. আজম ম-ল রানা। এতে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন ফুলবাড়ী প্রেসক্লাবের সভাপতি দৈনিক দেশ মা সম্পাদক সহকারী অধ্যাপক অমর চাঁদ গুপ্ত অপু, সাবেক ইউপি সদস্য বেলাল হোসেন, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আমিনুল ইসলাম, মোস্তাফিজুর রহমান, আয়োজক সংগঠনটির সভাপতি রেজাউল ইসলাম, সহসভাপতি বদিউজ্জামান বদরুল প্রমুখ।
সরেজমিনে দেখা যায়, মাঠের মাঝখানে পুঁতে রাখা হয়েছে একটি কলাগাছ। গোড়ায় পানিভর্তি মাটির ঘটি। পারপাশ চুন দিয়ে বৃত্তাকারে ঘিরে রাখা হয়েছে। খেলার মাঠটিও বৃত্তাকারে চিহ্ন দেওয়া হয়েছে। ঘটির পানিতে হাত ভিজিয়ে মাঠের বিভিন্ন পাশে খেলোয়াড়রা অবস্থান নিয়ে মাটিতে হাত রেখে শুরু হয় মন্ত্র পড়া। খেলায় চারজন মন্ত্রী (ওঝা বা তান্ত্রিক) এবং হাত খেলা বা পাতা হিসেবে ছিল তিনজন।
ঐতিহ্যবাহী এ খেলা দেখতে দুর-দুরান্ত থেকে এসে খেলাটি উপভোগ করেন দুই সহস্রাধিক বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ। এদিকে খেলাটিকে ঘিরে মাঠের চারিপাশে বসেছিল বাহারী খাবারের ও পণ্যের দোকান।
মন্ত্রী বা তান্ত্রিক হিসেবে অংশ নেন কাজীহাল ইউনিয়নের আমড়া গ্রামের আতিয়ার সর্দার, রশিদপুর মিরপুর গ্রামের নুরুজ্জামান, বেতদিঘী ইউনিয়নের কড়াই পশ্চিম পাড়ার আলম এবং মাদিলাহাটের মিলন। অন্যদিকে হাত খেলা বা পাতা হিসেবে অংশ নেন জাহিদুল ইসলাম, মোশারফ হোসেন এবং ভোলা।
জানা যায়, খেলায় ওঝা বা তান্ত্রিক মন্ত্রের সাহায্যে বেশি পাতাকে বস করে দাগের বাইরে নিয়ে নিজেদের কাছে আনতে পারলে সেই ওঝা বা তান্ত্রিক জয়লাভ করবে। অন্যদিকে পাতা ওঝার মন্ত্রে নিজেকে স্থির রেখে দাগের ভেতরে থাকতে পারলে তাকেও বিজয়ী বলে ঘোষণা করা হয়। ওঝা তার লক্ষ্য পূরণে ‘দুই চোখে দেখাদেখি/চার চোখে টানাটানি/সপ্ত চোখে বস/ওরে বম/আমাকে ছাড়িয়া যদি অন্যদিকে যাস/দোহাই তোর-মহাদেব/দোহাই তোর- ঈশ্বরের মাথা খাস’ মন্ত্রের সাহায্যে পাতাকে বস করে দাগের বাইরে নিয়ে আসতে কৌশল অবলম্বন শুরু করেন। কিন্তু মন্ত্রের শক্তিতে অনেক পাতা পরাস্ত করে বৃত্তের ভেতরে অবস্থান করে। আবার অনেকে বৃত্তের বাইরে ছুটে চলে আসে। দর্শকদের করতালি উৎসাহ আর উদ্দীপনার মধ্যদিয়ে চলে খেলাটি। গ্রাম বাংলার-এ ঐতিহ্যবাহী দেখতে হাজারো নারী-পুরুষের সমাগম ঘটে। টানা প্রায় ২ ঘণ্টা পর শেষ হয় তন্ত্র-মন্ত্রের ‘পাতা খেলা’।
বেতদিঘী ইউনিয়নের কড়াই পশ্চিম পাড়ার আলমের দল দুইটি পাতা টেনে চ্যাম্পিয়ন হয় এবং একটি পাতা টেনে রানার আপ হয় মাদিলাহাটের মিলনের দল। শেষে আনুষ্ঠানিকভাবে চ্যাম্পিয়ন দলকে একটি খাসি ও রানার আপ দলকে রাজ হাঁস তুলে দেন অনুষ্ঠানের অতিথিদ্বয়।
খেলায় অংশ নেয়া ওঝা বা তান্ত্রিকরা বলেন, ‘পাতা খেলা’ গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য। এখানে তান্ত্রিকের মন্ত্রের শক্তি পরীক্ষা হয়। হারজিত বড় বিষয় না। এ খেলা তন্ত্র-মন্ত্রের শক্তিতে হয়ে থাকে। তাই এ খেলা দেখতে হাজারো কৌতুহলী মানুষ আসেন। এ খেলায় সাধারণত যে যারমত তন্ত্র-মন্ত্রের শক্তিতে পাতা টেনে নিজেদের কাছে আনেন তাকেই বিজয়ী ঘোষণা করা হয়।
আয়োজকরা বলেন, গ্রাম বাংলা ঐতিহ্যবাহী পাতা খেলা বিলুপ্তির পথে। গ্রামীণ ঐতিহ্যকে ধরতে রাখতে এমন আয়োজন করা হয়েছে। এতে করে প্রত্যন্ত এলাকার মানুষ কিছুটা বিনোদন পেয়েছে। আমরা চাই সামাজিক সম্প্রীতি অটুট রাখতে সহনশীলতার চর্চা অব্যাহত থাকুক।