প্রবাসী শ্রমিক হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে জীবনের নিরাপত্তা নেই!


আন্তর্জাতিক ডেস্ক: , আপডেট করা হয়েছে : 10-10-2022

প্রবাসী শ্রমিক হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে জীবনের নিরাপত্তা নেই!

বাংলাদেশ থেকে কাজ আর উপার্জনের আশায় বিপুল সংখ্যক মানুষ প্রতিবছর বিদেশে যায়, তাদের কাছে মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ছাড়াও জনপ্রিয় একটি গন্তব্য হয়ে উঠেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। এরই মধ্যে বেশ বড় সংখ্যক বাংলাদেশি আফ্রিকা মহাদেশের একেবারে দক্ষিণের এই দেশটিতে গিয়েছে।

বাংলাদেশ থেকে মানুষজন দক্ষিণ আফ্রিকায় কাজের সন্ধানে যেতে শুরু করে নব্বই-এর দশক থেকে। তবে গত ১৫ বছর ধরে বাংলাদেশিদের জন্য দক্ষিণ আফ্রিকা হয়ে উঠেছে একটি গুরুত্বপূর্ণ গন্তব্য। দেশটি থেকে বাংলাদেশে আসা রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়ের পরিমাণও বাড়ছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে যেসব দেশ থেকে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স এসেছে, সেই তালিকায় দক্ষিণ আফ্রিকার অবস্থান ১২তম। এর পরিমাণ ছিল ৩১৪ মিলিয়ন বা ৩১ কোটি ৪০ লক্ষ মার্কিন ডলার। পাঁচ বছর আগের তুলনায় এই আয় দ্বিগুণ হয়েছে।

তবে দক্ষিণ আফ্রিকায় বাস করছেন এবং নিয়মিতভাবে দেশে পরিবারের সদস্য ও স্বজনদের কাছে টাকা পাঠাচ্ছেন এমন প্রবাসী কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে ধারনা পাওয়া যাচ্ছে যে সেখান থেকে ব্যাংকিং চ্যানেলে যত রেমিটেন্স বাংলাদেশে আসে, তার চেয়ে অনেক বেশি অর্থ আসে অনানুষ্ঠানিক পথে অর্থাৎ হুন্ডির মাধ্যমে।

দক্ষিণ আফ্রিকায় বেকারত্বের হার এখন প্রায় ৩০ শতাংশ। তারপরেও কেন এবং কীভাবে দক্ষিণ আফ্রিকা বিদেশে কর্ম-প্রত্যাশী বাংলাদেশিদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ গন্তব্য হয়ে উঠলো?


দক্ষিণ আফ্রিকায় বাংলাদেশিরা কী করেন?

প্রায় ১৬ বছর আগে বাংলাদেশ থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা গিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। বর্তমানে ব্লুমফন্টেইন শহর থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে তিনি একটি ডিপার্টমেন্ট স্টোরের মালিক। মি. রহমান টেলিফোনে বিবিসি বাংলাকে জানালেন, দক্ষিণ আফ্রিকায় যেসব বাংলাদেশি বসবাস করছেন তাদের মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ ব্যবসা এবং বিভিন্ন দোকানে চাকরী করেন। মুদির দোকান, ডিপার্টমেন্ট স্টোর, মোবাইল টেলিফোন, ইলেকট্রনিকস এবং টেকনোলজি একসেসরিজ-সহ নানা ধরণের পণ্যের দোকান সাজিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করেন সেখানকার প্রবাসী বাংলাদেশিরা।

"যারা প্রথমে আসেন তারা বাংলাদেশিদের মালিকানাধীন বিভিন্ন দোকানে চাকরি করেন। এরপর তারা নিজেই আস্তে আস্তে একটা দোকান দেন," প্রবাসী বাংলাদেশিদের উদ্যোক্তা হয়ে ওঠা সম্পর্কে বলেন জিয়াউর রহমান।

তিনি আরও জানালেন, বাংলাদেশ থেকে আসা নতুন একজন দোকান কর্মচারী বাংলাদেশি মুদ্রায় সাধারণত ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা বেতন পান।

"শেষ পর্যন্ত অবশ্য সবার টার্গেট থাকে একেবারে নিজের একটি ব্যবসা দাঁড় করানো। কয়েক বছর দোকানে চাকরী করে কিছু টাকা জমিয়ে নিজেই একটি দোকান দেয়ার চেষ্টা করেন এখানে আসা সবাই," বলেন এই প্রবাসী।


ব্যবসা করা কতটা কঠিন?

দক্ষিণ আফ্রিকায় বাস করা বাংলাদেশিদের বেশিভাগই থাকেন বড় শহরগুলোতে - যেমন জোহানেসবার্গ, কেপটাউন কিংবা ব্লুমফন্টেইন। তবে দেশটিতে ঠিক কত সংখ্যক বাংলাদেশি নাগরিক বাস করেন, তার সঠিক কোন পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আফ্রিকা উইংয়ের মহাপরিচালক তারিকুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেন, দক্ষিণ আফ্রিকায় আনুমানিক আড়াই থেকে তিন লক্ষ প্রবাসী বাংলাদেশি রয়েছেন বলে ধারনা করা হয়। তবে সরকারি তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে বৈধভাবে প্রায় এক লক্ষের মত বাংলাদেশি বসবাস করছেন। 

সেখানে বসবাসরত বাংলাদেশিদের ভাষ্য মতে, দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্যবসা করা বেশ সহজ। তাদের অনেকেই মনে করেন যে দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্যবসার অনেক সুযোগ রয়েছে এবং ভালো বিনিয়োগ করতে পারলে সেখানে ব্যবসায় উন্নতি করা যায়।

ব্লুমফন্টেইন থেকে জিয়াউর রহমান জানালেন, একটি মাঝারি মানের ডিপার্টমেন্ট স্টোর থেকে প্রতিমাসে বাংলাদেশি মুদ্রায় এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত মুনাফা করা যেতে পারে।

"এখানে আমাদের আসার একটাই কারণ, আর সেটা হচ্ছে বিজনেস। সবাই বিজনেস করে সাকসেস হইছে। শতকরা ৯৫ জনই সফল হইছে বলা যায়," বলেন জিয়াউর রহমান।

তবে মুদ্রার উল্টো পিঠও রয়েছে।


জীবনের নিরাপত্তা নাই?

দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রবাসীরা জানালেন যে দেশটিতে তাদের মালিকানাধীন দোকানপাটে হামলা এবং লুটতরাজ এখন প্রায় নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশটিতে বেকার সমস্যা প্রবল এবং বিদেশীদের ওপর হামলার ঘটনা মাঝেমধ্যেই আন্তর্জাতিক খবরের শিরোনাম হয়। বেশিরভাগ বড় শহরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বরাবরই উদ্বেগ আছে। বাংলাদেশ থেকে লিবিয়া-ইউরোপে মানব পাচার কেন ঠেকানো যাচ্ছে না?

দক্ষিণ আফ্রিকায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের একটি সূত্র জানিয়েছে, ২০১৫ সাল থেকে প্রায় ছয়শো'র মতো বাংলাদেশি নাগরিক সেখানে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন বলে তারা জানতে পেরেছেন।

তবে বিষয়টি নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কথা বলার জন্য দক্ষিণ আফ্রিকায় নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনারের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যবসা নিয়ে দ্বন্দ্ব এবং ব্যক্তিগত ও নারীঘটিত শত্রুতা এসব হত্যাকাণ্ডের কারণ ছিল বলে স্থানীয় প্রবাসীরা মনে করেন। তবে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মূল সমস্যা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, যার কারণে অনেকেই মনে করেন যে দক্ষিণ আফ্রিকায় তাদের জীবনের নিরাপত্তা নেই।

ব্লুমফন্টেইন থেকে জিয়াউর রহমান জানান যে গত পাঁচ মাস যাবৎ তিনি দোকান ও বাসার বাইরে কোথাও খুব একটা যাননি এবং রাস্তায় চলাফেরার সময় তিনি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন।

"আমার দোকান ও বাসা একসাথে। চারপাশে এমনভাবে গ্রিল দিয়ে আটকাইছি যাতে কেউ ভেতরে ঢুকতে না পারে। তারপরেও ভয় লাগে। রাস্তায় বাইর হইলেই অপহরণের ভয় লাগে," বলেন তিনি।


আফ্রিকা মহাদেশের অন্যতম সমৃদ্ধ দেশ হওয়ার পুরো মহাদেশ থেকেই দক্ষিণ আফ্রিকায় কাজের সন্ধানে অনেকেই যান। কিন্তু স্থানীয় একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের যথেষ্ঠ সুযোগ না থাকার কারণে দেশটিতে অভিবাসী বিরোধী সহিংসতা দেখা গেছে। অভিবাসী বিরোধী হামলার প্রেক্ষাপটে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরের শুরুতে দেশটিতে বসবাসরত বাংলাদেশিদের চলাচলে সতর্কতা জারি করেছিল বাংলাদেশ হাইকমিশন। ওই সময়ে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দক্ষিণ আফ্রিকার কর্তৃপক্ষের কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রবাসী বাংলাদেশিদের নিরাপত্তা দেয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছিল।

একজন কর্মকর্তা তখন বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন যে দেশটিতে অনেক বাংলাদেশি অবৈধভাবে বাস করেন, ফলে হামলা বা হুমকির শিকার হলে তাদের অনেকেই দূতাবাস বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অভিযোগ জানাতে যান না।


কীভাবে যায় দক্ষিণ আফ্রিকা? 

নয় বছর আগে দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়েছেন সাইফুল ইসলাম। তিনি চট্টগ্রাম থেকে প্রথমে গিয়েছিলেন দুবাই। এরপর দুবাই থেকে ইথিওপিয়া হয়ে মোজাম্বিকে যান সাইফুল ইসলাম।

"মোজাম্বিক থেকে রাতে ১১ ঘণ্টা হেঁটে সাউথ আফ্রিকা ঢুকছি," জানালেন মি. ইসলাম।

দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাসরত প্রবাসী কয়েকজন বাংলাদেশির সঙ্গে কথা বলে জানা গেল যে বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন পথে অবৈধ উপায়ে তারা দক্ষিণ আফ্রিকায় পৌঁছেছেন।

তারা বলছেন, দালালরা বিভিন্ন দেশের এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশন বিভাগে অর্থের বিনিময়ে কন্ট্রাক্ট করে রাখে, যাতে অভিবাসন প্রত্যাশীরা নির্বিঘ্নে ইমিগ্রেশন পার হতে পারে।

কিন্তু এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে যে ইমিগ্রেশন কাউন্টারে ধরা পড়ে দক্ষিণ আফ্রিকার বিভিন্ন এয়ারপোর্ট থেকে অনেক বাংলাদেশি দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন, জানালেন এই প্রবাসীরা।


দক্ষিণ আফ্রিকায় কেন এত বাংলাদেশি নিহত হচ্ছেন?

এই প্রক্রিয়ায় দক্ষিণ আফ্রিকা যেতে দালালদের দশ লাখ টাকা পর্যন্ত দিতে হয় বলে জানা গেছে। অনেকেই আবার ভিন্ন-ভিন্ন রুট ব্যবহার করে কয়েকবারের চেষ্টায় দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে পৌঁছান।

"বাংলাদেশ থেকে যারা যায়, তাদের প্রায় সবাই অবৈধ পথেই যায়। তারপর সেখানে গিয়ে লিগ্যাল কাগজপত্র করে," বলেন সাইফুল ইসলাম।

তবে তার মতে এতো বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ করে এবং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় যাওয়া যেমন ঠিক নয়, তেমনি সেখানে যাওয়ার পরও নিরাপদে থাকা যাবে কিংবা ব্যবসা করা যাবে, এমন কোন নিশ্চয়তাও নেই।

দক্ষিণ আফ্রিকায় আছেন এমন অনেক প্রবাসী বাংলাদেশি এখন ওই দেশ ছেড়ে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করছে বলে তিনি জানান।


সূত্র: বিবিসি


Publisher & Editor :Md. Abu Hena Mostafa Zaman

Mobile No: 01971- 007766; 01711-954647

Head office: 152- Aktroy more ( kazla)-6204  Thana : Motihar,Rajshahi
Email : [email protected], [email protected]