গত কয়েক বছর ধরে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্যদের কর্মকাণ্ড সারাদেশের মানুষের মাঝে যেমন নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করেছে, তেমনি সরকারের উচ্চ মহলেও বিষয়টি নিয়ে বেশ উদ্বিগ্নের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে উপাচার্যদের সেই বিতর্কিত কর্মকাণ্ড থেকে বেরিয়ে এসে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ‘মডেল’ হতে যাচ্ছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শিক্ষার্থীবান্ধব বিভিন্ন কর্মকাণ্ড যেমন দেশব্যাপী প্রশংসায় ভাসছে, তেমনি সামনে আরো অনেক শিক্ষার্থীবান্ধব ও গুণগত শিক্ষার পরিবেশ সম্পন্ন একটি বিশ্ববিদ্যালয় গঠনের জন্য নানান উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়টি।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার বলেন, ‘আমরা বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্ববিদ্যালয়ের মত বানাতে চাই। একটা সত্যিকারের বিশ্ববিদ্যালয় যেমন হওয়া উচিৎ, তেমনি হবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। আমি কোন উপাচার্য হিসেবে শিক্ষার্থীদের কাছে পরিচিত হয়ে থাকতে চাই না। আমি একজন শিক্ষক, আমার পরিচয় শুধু শিক্ষক, শিক্ষার্থীরা আমাকে শিক্ষক হিসাবে, তাদের অভিভাবক হিসেবে চিনবে। তাদের যত চাওয়া-পাওয়া থাকবে, তাদের চাওয়া পাওয়াগুলো যৌক্তিক হলে সবকিছুই আমরা পূরণ করবো। এছাড়াও আমাদের নিজস্ব কিছু কর্ম-পরিকল্পনা আছে, সেগুলো আমরা বাস্তবায়ন করব। আমাদের কর্মকাণ্ড শিক্ষার্থী ও দেশবাসী মূল্যায়ন করবে।’
এর আগে গত মঙ্গলবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাকচাপায় হিমেল নামে এক শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনায় উত্তাল হয়ে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয়। তবে সেই উত্তাল পরিবেশ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সরেজমিনে ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে উপস্থিত থেকে রাতব্যাপী তাদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করে সমাধানের দিকে নিয়ে যান।
পরের দিন সকাল সাড়ে ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে নিহত মাহমুদ হাবিব হিমেলের নামাযে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে হাজার মানুষের ঢল নামে। এসময় ভিসি গোলাম সাব্বির সাত্তার বলেন, ‘আমি আমার সন্তানের লাশ কাঁধে নিয়ে কি বা বলতে পারি? পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ কতটা ভারি আপনারা কি সেটা বুঝেন? অথচ তারই কাধে আমার উঠার কথা ছিল।’
হিমেল এর জানাজা শেষে উপাচার্য, উপ-উপাচার্যসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল প্রশাসনিক কর্তারা মৃতদেহ নিয়ে দাফনে অংশ নেয়ার জন্য নাটোরে উপস্থিত হন। সেখানে শোকাহত হিমেলের অসুস্থ মা, নানী, মামা ও নানাসহ সকলকেই সান্তনা দেন এবং দাফনকাজসহ অন্যান্য কাজের জন্য হিমেলের মাকে ৫ লাখ টাকার একটি চেক তুলে দেন।
দাফন সম্পন্ন করার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তারা। এরপর বিকেল সাড়ে চারটায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবাস বাংলাদেশ মাঠে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে উন্মুক্ত আলোচনায় বসেন তারা। সেখানে শিক্ষার্থীদের দাবির কথাগুলো শুনেন এবং সকল দাবি মেনে নেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এমন উন্মত্ত আলোচনার ইতিহাস বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নতুন করে আশা দেখাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
উন্মুক্ত আলোচনার সেই ছবি মুহূর্তের মধ্যেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে যায়। সারাদেশের মানুষ প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয় উপাচার্যের।
উপাচার্যের এমন মুক্ত আলোচনার আয়োজন সম্পর্কে মিজানুর রহমান মিজান নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বনাম শিক্ষার্থীদের মধ্যে উন্মুক্ত আলোচনা প্রশংসার দাবি রাখে। শুরু থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনিয়ম দুর্নীতি নিয়ে সমালোচনা করে আসছি, প্রশংসা করার মতো কোন ইস্যু পাইনি, কিন্ত এই উন্মুক্ত আলোচনা ও সিদ্ধান্তগুলো প্রশংসার যোগ্য। ভিসি স্যারকে যথেষ্ট আন্তরিক এবং ছাত্রবান্ধব মনে হয়েছে। এই উন্মুক্ত আলোচনার সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়ুক দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে।’
সাদরুল অভি নামেন আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ‘এর থেকে সুন্দর দৃশ্য মনে হয় আর কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা যায়নি। দাবি-দাওয়া ও দীর্ঘদিনের আলোচ্য সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের বৈঠক উন্মুক্ত মাঠে। এই সংস্কৃতি দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়ুক।’
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. সুলতান উল ইসলাম বলেন, ‘একদিনের আলোচনা বা কর্মকাণ্ডই শেষ নয়। আমরা কতটুকু শিক্ষার্থীবান্ধব হচ্ছি, শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করতে পারছি সেটা আপনারা পরবর্তীতে আরো দেখতে পারবেন। তবে সবার আগে আমরা একটা বিষয় পরিষ্কার করতে চাই, শিক্ষক শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে দূরত্ব সেটা আমরা সবার আগে কমিয়ে আনার চেষ্টা করবো।’
রাজশাহীর সময় / এফ কে