জ্ঞান ও সৃজনশীলতার বাতিঘর চলনবিলের ভাসমান স্কুল

আপলোড সময় : ০৭-১২-২০২৫ ০১:০৪:০৩ পূর্বাহ্ন , আপডেট সময় : ০৭-১২-২০২৫ ০১:০৪:০৩ পূর্বাহ্ন
বাংলাদেশ নদ-নদীর দেশ। নদী বিধৌত বাংলার প্রকৃতিতে জালের মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে এবং গ্রামের পর গ্রাম বুক চিতিয়ে প্রবহমান নদীগুলো।শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই নদীগুলোর আধিপত্য বিরাজমান। শান্ত শিষ্ট সুন্দর নদীগুলো কখনো রুদ্রমূর্তি ধারণ করে।জলবায়ুর পরিবর্তনে এবং মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বর্ষাকালে চারিদিকে পানি টুইটুম্বুর হয়ে উঠে।

ঋতুরঙ্গময়ী রুপসী বাংলা সুরম্য লীলাক্ষেত্র হলেও বিশ্বের অন্যতম নীচু এলাকায় বাংলাদেশের মানুষের বসবাস।দেশের বৃহত্তম চলন বিলে (১১৫০ বর্গ কি:মি:) রয়েছে নানা রকমের মাছ,জীব বৈচিত্র্য ও জলজ প্রাণীর আবাসস্থল। পাবনা,সিরাজগঞ্জ ও নাটোরের ৯ টি উপজেলায় ৪৭ টি ছোট বড় নদী,ছোট ছোট বিল,জলাশয় ও জলপথ মিলেই চলন বিল।

সারা বছর পানি চলমান থাকায় 'চলন' শব্দটি এবং নিম্ন ভূমির জলাশয়ের কারণে 'বিল' শব্দটি মিলেই চলন বিল।এখানকার মানুষের জীবনে রয়েছে পাওয়া না পাওয়ার বেদনা।ঘর-বাড়ি,বিভিন্ন রকমের প্রতিষ্ঠান সমতল ভূমি থেকে কমপক্ষে ১০/১৫ ফুট উঁচু। যাতায়াতের জন্য দুর্গম এ গ্রামগুলোতে প্রায় প্রতিটি পরিবারে আছে ডিঙ্গী নৌকা। নীচু এলাকায় প্রায় সারা বছর পানি থাকার ফলে এ এলাকার মানুষ সুবিধা বঞ্চিত,  চরম অবহেলিত ও দীর্ঘ মেয়াদি প্রাকৃতিক দূর্যোগে জর্জরিত।এখানে নিত্য সংগী অভাব। শিক্ষা যেন সোনার হরিণ।ইতিহাস বলে কিছু সংখ্যক মানুষের জন্ম হয় " সময়ের প্রয়োজনে'।এ এলাকার কৃতি সন্তান, অদম্য মেধাবী বুয়েটিয়ান স্থপতি প্রকৌশলী মোহাম্মদ রেজোয়ান,নির্বাহী পরিচালক, সিধুলাই স্ব -নির্ভর সংস্থা ২০০২ সালে কিছু সংখ্যক ছাত্র/ছাত্রী নিয়ে নৌকায় ভাসমান স্কুল চালু করেন। ছোট বেলা থেকেই তিনি দেখেছেন এখানে প্রতিবছর বন্যার ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যেতে। কিন্তু তাঁর মন বারবার ডেকে বলছে একটা বড় কোন কিছু বা স্থায়ী সমাধান তাঁকে  যে করতেই হবে। উদ্ভাবন করতে হবে শিক্ষার টেকসই মডেল।যা এখানকার মানুষের সংকট মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ  ভূমিকা রাখবে।গত দুই দশকে তাঁর নেতৃর্ত্বে পরিচালিত উদ্দ্যোগ দেখিয়েছে যে, জলবায়ু অভিযোজনে স্থানীয় উদ্বাবন  কেবল একটি দেশেই নয়,বিশ্বজুড়ে প্রভাব ফেলতে পারে। দেশি বিদেশি ডোনারের  সহযোগীতায় স্টুডেন্টদের বিনামূল্যে স্কুলগুলোতে পাঠদান হয়। ২৬ টি নৌকায়, ৩ শিফটে ,৭৮ জন শিক্ষক/শিক্ষিকা ২৩৪০ জন শিক্ষার্থীকে আনন্দের সাথে পাঠদান করাচ্ছে।দেখতে যেন, প্রতিটি স্কুলই এক সুন্দর স্কুল বটে।কোন ঘর বা ভবন নয়,নেই সীমানা প্রাচীর, আছে অবারিত মুক্ত সবুজ মাঠ।

নৌকায় চড়ে বেড়ানো এক ঘাট থেকে অন্য ঘাট,এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে যাওয়ার দারুণ মজা।আশার প্রদীপ এ স্কুলগুলোর প্রতিটিতে রয়েছে সৌরবিদ্যুৎ, বৈদ্যুতিক পাখা। বিদ্যুতের আলোর ঝলকানিতে বদলে যাচ্ছে তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যত।আলোর ছোঁয়ায় তারা আজ উদ্ভাসিত ।ছোট্ট সোনামণিরা এখন বড় বড় স্বপ্ন দেখছে। ১ম থেকে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত  এ স্কুল গুলো আজ বিশ্বে 'রোল মডেল '।

দুনিয়া জুড়ে আজ এর খ্যাতি বা সুনাম ছড়িয়ে পড়ছে। শন শন বাতাস, কনকনে ঠান্ডা ,প্রতিকূল বৈরি আবহাওয়া, দারিদ্রতা, প্রাকৃতিক দূর্যোগে,দুরত্ব, সহ যে কোন বাধাই তাদের অগ্রযাত্রা আর ঠেকাতে পারছে না।শুধু কি লেখাপড়াই শেখানো হয় এখানে,না। তা নয়।

নিয়মিত চিকিৎসক রেখে গ্রামীণ শিশু ও নারীদের স্বাস্থ্যসেবা,জলবায়ুর প্রভাবে কি ক্ষতি হতে পারে,অনাবাদি জমিতে বাড়তি ফসল ফলানো,গবাদি পশুর পরিচর্যা, শিশু ও বাল্য বিবাহের বিষয়ে সচেতনতা ইত্যাদির প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা এখানে রয়েছে। প্রতিটি ভাসমান নৌকায় আধুনিক সুযোগ সুবিধার পাশাপাশি পাঠাগার, পাঠশালা আর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো গোহালা নদীতে ইঞ্জিন চালিত নৌকা দিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখলাম এবং তাদের সাথে ছবি তুললাম, কথা বলে মনের ভাব আদান-প্রদান করলাম।শিক্ষায় নতুন উদ্ভাবন ও জীবনব্যাপী শিক্ষা প্রসারে  মোহাম্মদ রেজোয়ান সাহেব এবং তার প্রতিষ্ঠান বেশ কয়েকটি পুরস্কার অর্জন করে।

ইয়েল বিশ্ব ফেলো,জাতিসংঘের ইউনেস্কো পুরস্কার তাদের মধ্যে অন্যতম।  ভাসমান স্কুলের ধারণা এখন শুধু আমাদের দেশই নয় এশিয়া, আফ্রিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকার অনেক দেশকে একই ধরণের উদ্দ্যোগ বাস্তবায়নে অনুপ্রাণিত করেছে। বাংলাদেশ সরকার এই ভাসমান স্কুলগুলোকে জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা ২০৫০ এ অন্তর্ভুক্ত করেছে।

অনন্য, অসাধারণ এবং অসম্ভব কাজকে  সম্ভবে পরিণত করার জন্য মোহাম্মদ রেজোয়ান এর নাম আজ সারা বিশ্বব্যাপী প্রসংশিত এবং উচ্চারিত হচ্ছে।কোন দূর্যোগই শ্রেষ্ঠ মানুষ জাতিকে দমিয়ে রাখতে পারে না,আর কখনোও পারবেও না। বিশ্বজয়ী ভাসমান স্কুলের উদ্ভাবক যুগে যুগে মানুষের প্রেরণার মাইলস্টোন বা ধ্রুবতারা হিসেবে থাকবে।
 

সম্পাদকীয় :

Publisher & Editor :Md. Abu Hena Mostafa Zaman

Mobile No: 01971- 007766; 01711-954647

রাজশাহীর সময় অনলাইন নিউজ পোর্টাল আবেদনকৃত চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর, ঢাকা ।

অফিস :

Head office: 152- Aktroy more ( kazla)-6204 Thana : Motihar,Rajshahi

Email : [email protected],                    [email protected]