বালু ইজারার আড়ালে খুন, লুট ও চাঁদাবাজি: অভিযুক্ত নিজেই ফোন করে যা বললেন

প্রকৌশলী না ‘সশস্ত্র’ সম্রাট: পদ্মার চরে ‘কাকন বাহিনী’র রহস্যময় উত্থান

আপলোড সময় : ১৫-১১-২০২৫ ১০:০৮:০৮ অপরাহ্ন , আপডেট সময় : ১৫-১১-২০২৫ ১০:০৮:০৮ অপরাহ্ন
 
রানা শেখ, বাঘা প্রতিনিধি: পদ্মার বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলে দীর্ঘদিনের ত্রাসের রাজত্ব শেষে গত ৯ নভেম্বর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী 'অপারেশন ফার্স্ট লাইট' নামে সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে ৫৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। এই অভিযানে পদ্মার চরে সক্রিয় ১১টি সন্ত্রাসী বাহিনীর মধ্যে অন্যতম হিসেবে সামনে আসে 'কাকন বাহিনী'র নাম। তাদের বিরুদ্ধে চরের বালু লুট, ফসল দখল, চাঁদাবাজি এবং কথায় কথায় গুলি করে মানুষ হত্যার মতো গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।

অভিযানের পরদিন এক নাটকীয় পরিস্থিতিতে এই বাহিনীর প্রধান দাবি করা মো. রোকনুজ্জামান কাকন ওরফে ইঞ্জিনিয়ার কাকন (প্রকৃত নাম: হাসানউজ্জামান কাকন) নিজেই এই প্রতিবেদককে ফোন করে প্রায় ৩৪ মিনিট কথা বলেন। কাকন নিজেকে নির্দোষ, বৈধ ব্যবসায়ী এবং ষড়যন্ত্রের শিকার বলে দাবি করলেও, তার বক্তব্য ও অভিযোগের পেছনের চিত্রটি ভিন্ন ইঙ্গিত দিচ্ছে।

📞 কাকনের জবানবন্দি: বৈধ ব্যবসা, নাকি অবৈধ আড়াল?
ফোনে কথা বলার শুরুতে হাসানউজ্জামান কাকন নিজের পরিচয় দেন একজন প্রকৌশলী হিসেবে, যিনি বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করেছেন এবং দীর্ঘ সময় বিদেশে কর্মরত ছিলেন।

বৈধতার দাবি: তিনি দাবি করেন, তিনি ২০২০ সাল থেকে নাটোরের লালপুরের দিয়াড় বাহাদুরপুর বালুমহাল ইজারা নিয়ে বৈধভাবে বালুর ব্যবসা করছেন। ইজারার মূল্য ৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা এবং তিনি মূল মালিক নন, একজন অংশীদার।

'কাকন বাহিনী' নিয়ে প্রশ্ন: তার নামের সঙ্গে মিলিয়ে কেন 'কাকন বাহিনী' বলা হচ্ছে, এই প্রশ্নের জবাবে তিনি এটিকে 'ষড়যন্ত্রমূলক' এবং 'দুর্বৃত্তদের ফটোশুট করা ও বানানো' বলে উড়িয়ে দেন।

ষড়যন্ত্রের অভিযোগ: ২৭ অক্টোবর চরে ফসল কাটাকে কেন্দ্র করে তিন কৃষক হত্যার ঘটনায় তার নামে মামলা হলেও তিনি দাবি করেন, পুরো ঘটনাটি সাজানো। তার নামে হওয়া ছয়টি মামলার কোনোটির সঙ্গেই তিনি জড়িত নন।

স্পিডবোটের রহস্য: আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য শহিদুল ইসলামের (বকুল) সঙ্গে স্পিডবোটে থাকা ছবির বিষয়ে স্বীকার করলেও, তিনি দাবি করেন ছবিটি একটি নৌকাবাইচ দেখতে যাওয়ার সময়ের। অন্যদিকে, স্পিডবোট ছিনতাইয়ের ঘটনায় তিনি উল্টো পাবনার সেই ড্রাইভারের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী ভাড়া করে তাদের চরে গুলি করার অভিযোগ তোলেন।

কাকনের মূল বক্তব্য হলো: "আমি বা আমার লোক কোনো দিন ১০ টাকা চাঁদা নিয়েছেন, কাউকে মেরেছেন, সেই প্রমাণ নেই। সবই সাজানো নাটক।"

🔪 চরের জমিতে ত্রাস: অভিযোগনামা বনাম বাস্তব চিত্র
পুলিশ এবং স্থানীয় সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য কাকনের আত্মপক্ষ সমর্থনের বিপরীতে ভিন্ন বাস্তবতার ইঙ্গিত দেয়।

১. বালু ইজারা ও একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ
কাকন বালু ব্যবসায় লোকসানের কথা বললেও, স্থানীয়দের অভিযোগ—তার বাহিনীর ভয়েই অন্য কেউ ইজারা বা দরপত্রে অংশ নিতে সাহস পায় না। ফলে প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট চক্রই ইজারা নিতে সক্ষম হয়। এটি চরে একটি একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। কাকনের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, অবৈধ বালি উত্তোলনই লোকসানের কারণ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তার বাহিনী সক্রিয় থাকা সত্ত্বেও কারা এই অবৈধ উত্তোলন করছে?
ইজারার জটিলতা: কাকন জানান, তিনি চার বছরই ইজারার সঙ্গে আছেন এবং ঘাট প্রতি বছর নবায়ন করা লাগে। এটি বৈধতার প্রমাণ দিলেও, তার নামের সঙ্গে জড়িত অপরাধের অভিযোগগুলো ইজারার আড়ালে অর্থনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের দিকেই ইঙ্গিত করে।

২. সশস্ত্র মহড়া ও হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে
চরের স্থানীয় বাসিন্দারা প্রশাসনকে ড্রোন ভিডিও দিয়ে জানিয়েছেন যে কাকন বাহিনী রাজশাহী, কুষ্টিয়াসহ চার জেলার বিস্তীর্ণ পদ্মা নদীতে স্পিডবোট নিয়ে নিয়মিত সশস্ত্র মহড়া দেয়। এটি চরে তাদের সামরিক দাপট প্রতিষ্ঠার স্পষ্ট প্রমাণ।

২৭ অক্টোবরের নৃশংসতা: তিন কৃষক হত্যার ঘটনায় কাকনের নাম প্রধান আসামি হিসেবে আসায় স্পষ্ট হয়, ফসল কাটার মতো সাধারণ ঘটনাও চরের আধিপত্যবাদী গোষ্ঠীগুলোর কাছে জীবন-মরণের প্রশ্ন। পুলিশও নিশ্চিত করেছে, এই বাহিনীর বিরুদ্ধে কথায় কথায় গুলি করা, মানুষ হত্যা করা, অপহরণ ও চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে।

৩. নামের বিভ্রান্তি
মামলার এজাহারে কাকনের নাম হাসানউজ্জামান কাকন বা মো. রোকনুজ্জামান কাকন ওরফে ইঞ্জিনিয়ার কাকন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। একাধিক নাম ব্যবহারের বিষয়টি অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের মধ্যে পরিচয় গোপন রাখার প্রবণতা বা আইনি জটিলতা তৈরির কৌশলের অংশ হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

'অপারেশন ফার্স্ট লাইট' চরের অপরাধ চক্রের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী বার্তা দিলেও, কাকন বাহিনীর প্রধানের সরাসরি ফোন কল এবং নিজেকে প্রকৌশলী হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা একটি মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করেছে। এটি কি নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার চেষ্টা, নাকি অপরাধ আড়াল করার কৌশল—তা নিবিড় তদন্তের মাধ্যমে স্পষ্ট হবে।

এখন সময় এসেছে, পুলিশি অভিযান এবং কাকনের দেওয়া তথ্যকে ভিত্তি করে দ্রুত, স্বচ্ছ ও ফরেনসিক ভিত্তিক তদন্ত নিশ্চিত করা। চরের সাধারণ মানুষ তাদের জীবন, ফসল ও বালুসম্পদের নিরাপত্তা চায়। এই ঘটনা প্রমাণ করে, চরাঞ্চলে শান্তি ফিরিয়ে আনতে কেবল অভিযানই যথেষ্ট নয়, অবৈধ বালু বাণিজ্য এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের মূল উৎসে আঘাত করা জরুরি।

সম্পাদকীয় :

Publisher & Editor :Md. Abu Hena Mostafa Zaman

Mobile No: 01971- 007766; 01711-954647

রাজশাহীর সময় অনলাইন নিউজ পোর্টাল আবেদনকৃত চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর, ঢাকা ।

অফিস :

Head office: 152- Aktroy more ( kazla)-6204 Thana : Motihar,Rajshahi

Email : [email protected],                    [email protected]