চল্! কোনও ব্যাপার না, আমি তো আছি তোর সঙ্গে!

আপলোড সময় : ০২-১১-২০২৫ ০৩:১২:৪৫ অপরাহ্ন , আপডেট সময় : ০২-১১-২০২৫ ০৩:১২:৪৫ অপরাহ্ন
উইকিপিডিয়া বলছে, আপনার জন্ম বেঙ্গালুরুতে। কিন্তু আপনার জন্ম তো পুণেতে! শুনে একচোট হাসলেন উল্টোদিকে বসা তেত্রিশের যুবতী। এবং সেই অট্টহাস্যটা ধরে রেখেই বললেন, ‘‘ওয়েল, আমার সম্পর্কে যে সমস্ত অসত্য বাজারে ঘোরে, এটা তার মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে নির্দোষ। সবচেয়ে সুইট। যাকগে, যেটা ইন্টারনেট বলেছে, সেটাই বিশ্বাস করে নিন। কী আর হবে!’’

সত্যিই তো। কী আর হবে! আর কী-ই বা হওয়ার আছে! এই ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে নতুন করে রিয়া চক্রবর্তীর জীবনে আর কী খারাপ ঘটতে পারে? নতুন কী গুজব রটতে পারে? নতুন কী ভাবে আর চরিত্রহনন করা হতে পারে তাঁর?

পাঁচ বছর আগে ২০২০ সালে অভিনেতা সুশান্ত সিংহ রাজপুতের মৃত্যুর পরে তাঁর বান্ধবী রিয়ার বিরুদ্ধে বিচিত্র সমস্ত অভিযোগ উঠেছিল। সুশান্তকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়া, সুশান্তের সম্পত্তি নয়ছয় করা থেকে শুরু করে সুশান্তকে ‘কালা জাদু’ করার অভাবনীয়, কিন্তু জনপ্রিয় সমস্ত অভিযোগ।

ভরা কোভিডের সেই সময়ে বিভিন্ন চ্যানেলের স্টুডিয়োয় খাপ পঞ্চায়েত বসেছিল রিয়াকে নিয়ে। বিচারসভা বসেছিল সমাজমাধ্যমে। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা বলছে, সুশান্তের মৃত্যু ‘আত্মহত্যা’ নয়, ‘হত্যা’, এই মর্মে সেই সময়ে ৭,০০০ ইউটিউব ভিডিয়ো বানানো হয়েছিল, টুইট করা হয়েছিল ১ লক্ষ! উত্তাল হয়েছিল মহারাষ্ট্র এবং বিহারের রাজনীতি। সেই ঘটনাপ্রবাহের সবচেয়ে বড় শিকার ছিলেন রিয়া। তাঁকে জেলে যেতে হয়েছিল। গ্রেফতার হয়েছিলেন তাঁর ভাই শোয়াইকও। ঘটনাচক্রে, যিনি তখন ৯৮ শতাংশ নম্বর পেয়ে বিজ়নেস ম্যানেজমেন্ট কোর্সে ভর্তি হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

পাঁচ বছর পরে সিবিআই ‘ক্লিনচিট’ দিয়েছে রিয়াকে। ফেরত দেওয়া হয়েছে তাঁর পাসপোর্ট। সিবিআই বলেছে, না তিনি সুশান্তের আত্মহত্যায় প্ররোচনা দিয়েছিলেন, না সুশান্তের টাকাপয়সা নিয়ে কোনও গোলমাল করেছিলেন, না সুশান্তের জীবন নিয়ন্ত্রণে ‘কালা জাদু’ করেছিলেন।

কিন্তু তাতে রিয়া তাঁর জীবন ‘টাইম ট্রাভেল’ করে পিছিয়ে নিয়ে গিয়ে স্লেট মুছে আবার নতুন করে শুরু করতে পারেননি। তাঁর আর ছবিতে অভিনয় করা হয়নি। সম্ভবত আর হবেও না। পাসপোর্ট ফেরত পেয়েছেন বটে। যে পাসপোর্টের অভাবে বিদেশে বেড়াতে না যেতে পেরে একটা সময়ে খারাপই লাগত, এখন সেই নথি হাতে পেয়ে দেখছেন, বিদেশে যাওয়ার স্পৃহাটাই তাঁকে ছেড়ে গিয়েছে। বরং মনে হচ্ছে, পাসপোর্টটা তাঁর কাছে মুক্তির সূচক। তাতে নতুন করে ভিসার ছাপ পড়ুক বা না-পড়ুক। ভাই শোয়াইকের ভর্তি হওয়া হয়নি বিজ়নেস ম্যানেজমেন্ট কোর্সে। আপাতত রিয়া-শোয়াইক রেডিমেড জামাকাপড়ের ব্যবসা করেন। নাগরিক এবং ঈষৎ সম্মানজনক ভাষায় ‘ক্লোদিং লাইন্‌স’। সুঘটনাচক্রে, ‘চ্যাপ্টার টু’ নামে সেই ব্যবসা সফল। অতএব রিয়া হাসতে হাসতে বলছেন, ‘‘আমি তো ভেবেছিলাম এটার নাম দেব ‘চুড়েল কা বদলা’! পেত্নির প্রতিশোধ!

বাবা সেনাবাহিনীর চিকিৎসক ছিলেন। পদমর্যাদায় লেফটেন্যান্ট কর্নেল। মা, কিমাশ্চর্যম, প্রাক্তন সাংবাদিক! বাবার বদলির চাকরি। ফলে ১২ বছরে নয়-নয় করে ১৪টি স্কুলে পড়েছেন রিয়া। প্রতি বছরে নতুন নতুন বন্ধু বানাতে হয়েছে। ২০১২ সালে তেলুগু ছবি দিয়ে অভিনয়ের কেরিয়ার শুরু। তার পরে এম টিভি এবং কিছু হিন্দি ছবিতে ছুটপুট রোল করতে করতে দ্বিতীয় বা তৃতীয় সারির অভিনেত্রীর পর্যায়ে পৌঁছোনো। ২০১৯ সাল থেকে সুশান্তের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল তাঁর। দু’জনে একত্রবাসও শুরু করেছিলেন মুম্বইয়ে। তার পরে তাঁদের ব্রেক আপ এবং ২০২০ সালের ১৪ জুন সুশান্তের মৃত্যু।

মহিলা। যুবতী। তন্বী। সুন্দরী। তায় আবার হিন্দি ছবির অভিনেত্রী। গ্ল্যামারজগতের সঙ্গে জড়িত। তখনও পর্যন্ত দুর্দান্ত সফল না হলেও বড় সাফল্যের দোরগোড়ায় কড়া নাড়ছেন। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে স্বাধীন। পছন্দের সঙ্গীর সঙ্গে একত্রবাস করেন। ইনি তো ‘টার্গেট’ হিসাবে একেবারে খাপে খাপ। আমাদের চারপাশে যে স্বার্থপর, অসূয়াপ্রবণ, অন্যের খারাপ থাকায় বা অন্যকে খারাপ রাখার বিনিময়ে নিজেরা ভাল থাকার জগৎ, সে জগৎ তো রিয়াকে চাঁদমারি করবেই। কিন্তু সে তো গেল এ দেশের আমজনতা। যারা ভাল বা খারাপ সবকিছুতেই লাফিয়ে পড়ে নিজেদের ডিজিটাল স্বাক্ষর রেখে যেতে চায়। খারাপটাই বেশি। কিন্তু তা বাদ দিয়েও বিভিন্ন তথাকথিত নিউজ় চ্যানেলে রিয়া সম্পর্কে যা বলা হয়েছিল, ভাবলে এখনও গা ঘিনঘিন করে। কদর্য! কিছু টিআরপি-ভোগী নাটুকে অ্যাঙ্কর, কিছু ক্ষমতাগৃধ্নু রাজনীতিক এবং ‘সফ্‌ট টার্গেট’ খুঁজে বেড়ানো মানুষ (মানুষই তো?) মাত্র আঠাশ বছর বয়সে এক তরুণীর গোটা জীবনটাই তাঁর কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিলেন। ওই লোকগুলোর জন্য তিরিশে পৌঁছোনোর আগে তাঁর জীবন পিছু হটতে হটতে শূন্য থেকে পিছিয়ে মাইনাসে চলে গিয়েছিল। সেখান থেকে একটু একটু করে এগোতে এগোতে পাঁচ বছর পরে এখানে এসে পৌঁছেছেন যে যুবতী, তাঁর মানসিক এবং চারিত্রিক দৃঢ়তা আশ্চর্য হয়ে দেখার মতো।

তেমনই দ্রষ্টব্য তাঁর জীবনের ধ্বংসস্তূপ। তখনটা না থাকলে এখনটা বোধহয় এত বিস্ময়কর মনে হত না।

টানা দু’সপ্তাহ জেলে কাটানোর পরে রিয়ার মনে হয়েছিল, আরে! বাইরের জগৎ কি তাঁর কথা ভুলেই গেল? তাঁকে কি আর কেউ কোনওদিন জেলের বাইরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে না? মনে হত, তাঁকে কি কেউ আর বিয়ে করতে চাইবে? তিনি কি আর কখনও কোনও ছবিতে অভিনয় করতে পারবেন?

রিয়ার কাহিনি ভাবতে ভাবতে মনে হচ্ছিল, সত্যিই, কত সহজে কোনও সফল মানুষকে দাগিয়ে দেওয়া যায়! পূর্বাপর, সত্যাসত্য বিচার না করে কত অনায়াসে নিজের সোশ্যাল মিডিয়ার দেওয়ালে তাকে দোষী প্রতিপন্ন করে দেওয়া যায়। নিমেষে সেই অসত্য পোস্ট দিগ্বিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। কিছু উল্লসিত, কিছু উদ্বিগ্ন, কিছু কৌতূহলী ফোন বাজতে শুরু করে। অস্তিত্ব নিয়ে সঙ্কট তৈরি হতে থাকে। নিজের উপর অবিশ্বাস তৈরি হয়। মনে হয়, আশপাশের সকলে আঙুল তুলছে। আবডালে আলোচনা করছে। উপায় থাকলে এড়িয়ে যাচ্ছে। দেখা করলেও সেই সাক্ষাৎ সর্বসমক্ষে লুকিয়ে রাখছে। ছবি তুললেও সে ছবি নিজের টাইমলাইনে দিচ্ছে না। পাছে ‘হরিজন’-এর সঙ্গে গলাগলিতে তাকেও সমাজে পতিত হতে হয়! অবিরত ডালপালা মেলে একের পর এক গসিপ।

কিন্তু সত্যের একটা আলাদা শক্তি আছে। নিজের সত্যের সঙ্গে থাকলে আপনি এক আশ্চর্য শক্তির অধিকারী হবেন।

জন্মসূত্রে বঙ্গতনয়া রিয়া বলছিলেন, ‘‘তখন সকলে আমায় ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল। বন্ধুরাও পাশে দাঁড়াতে ভয় পেত। তবে আমি ওদের দোষ দিই না। তখন আমার সঙ্গে ওদের কোথাও দেখা গেলে ওদেরও বিপদ। ওদের নিয়েও নিন্দে-মন্দ শুরু হত। বাট নাউ আই রিয়েলি ডোন্ট কেয়ার অ্যাবাউট হোয়াট পিপ্‌ল থিঙ্ক অ্যাবাউট মি। এটা কথার কথা নয়। এখন আমি সত্যিই নিজেকে স্বাধীন আর মুক্ত ভাবি।’’ একটু বিরতি দিয়ে, ‘‘আমরা তো বরাবর একরকম থাকি না। আমিও আর আগের মতো নেই। পাল্টে গিয়েছি। এখন পরিবার ছাড়া আমি আর কাউকেই বিশ্বাস করি না।’’

শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, ‘ভিক্টিম’ হব না ‘সার্ভাইভার’, সেটা শেষপর্যন্ত আমাদেরই উপর নির্ভর করে। বেশির ভাগ মানুষই অবশ্য ‘ভিক্টিমহুড’ পছন্দ করেন। কারণ, নিজেকে ‘পরিস্থিতির শিকার’ বলে ভেবে নেওয়ার মধ্যে একটা প্রলোভনের হাতছানি আছে। একটা অন্ধকার দিক আছে। যে কোনও অন্ধকারের মতোই সেটাও লোভনীয়। আকর্ষক। মাদকতাময়। প্লাস অনেকে তখন ছদ্ম সহানুভূতি, কপট উদ্বেগ দেখায়। সেই মায়াটা, সেই গুরুত্বটা পেতে ভাল লাগে। সম্ভবত সেই কারণেই সেটা থেকে মুক্তি পেতেও চাই না। ‘ভিক্টিমহুড’কে আমরা সেই সময়ের যন্ত্রণার সঙ্গে একাত্ম করে দেখি। সেই যন্ত্রণাটাই আমাদের ‘পরিচয়’ হয়ে ওঠে। কিন্তু ‘সার্ভাইভার’এর পরিচয় হয়ে দাঁড়ায় অতীত যন্ত্রণায় ভর করে তার উঠে দাঁড়ানোর, ফিরে আসার কাহিনি। যেমন আমরা জীবন এবং সমাজের অন্যায্য মার খেতে খেতে ধ্বস্ত হয়ে যে মাটিতে ভূমিশয্যা নিই, সেই মাটিতেই ভর করে আবার উঠে দাঁড়াই, তেমনই অতীতের যন্ত্রণার উপর ভর করেই ‘সার্ভাইভার’ নির্মাণ করেন প্রত্যাবর্তনের সৌধ।

যেমন রিয়া করেছেন। কারণ, তিনি ঠিক করেছিলেন, ‘ভিক্টিম’ হয়ে থাকবেন না। তাঁর যা পরিস্থিতি ছিল, তেমন হলে ১০ জনের মধ্যে ৯ জনের ভিতর নিজেকে ‘পরিস্থিতির শিকার’ ভাবার নেতিবাচক প্রবণতা তৈরি হয়। প্রথম প্রথম তাঁরও হয়েছিল। রিয়া বলছিলেন, ‘‘আই ওয়াজ় অ্যাট রক বটম! জেলারকে জিজ্ঞাসা করতাম, এই সলিটারি সেলটা থেকে কি কোনওদিন বাইরে বেরোতে পারব?’’ বলতে বলতেই দর্শকদের দিকে তাকিয়ে, ‘‘ডোন্ট ফিল ব্যাড। ওটা পাঁচ বছর আগে হয়ে গিয়েছে। এখন আমি খুব ভাল আছি। অ্যাম গুড! অ্যাম গ্রেট! অ্যাম মেকিং লট্স অফ মানি! আমার কথা ভেবে আবার কান্নাকাটি শুরু করবেন না। তা হলে আমাকেই আবার আপনাদের সান্ত্বনা দিতে হবে। আমার কারও করুণা চাই না। এখন আমার লক্ষ্য— নো পিটি, নো পতি, ওনলি সম্পত্তি!’’ করুণা চাই না, স্বামী-সংসারও চাই না। শুধু সম্পত্তি চাই।

সেই থোড়াই কেয়ার বাচনভঙ্গিতেই তিনি বলে যান, ‘‘জীবনের অন্ধকারতম দিনগুলোই আমায় সবচেয়ে বেশি আলো দেখিয়েছে। জেল থেকে বেরোনোর পর রোজ সকালে উঠে ব্রাশ করার সময় আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে বলতাম, কী রে? ফাটছে তো? ঠিক আছে। কোনও ব্যাপার না। চল্, আমি আছি তোর সঙ্গে!’’

শুনে মনে মনে হাততালি দিতে ইচ্ছে করছিল। সত্যিই তো! নিজের পাশে নিজে থাকার যে শক্তি, তার সঙ্গে বাইরে থেকে জোগানো কোনও শক্তির কোনও তুলনা হয় না। কোনও সমাজ তাকে একঘরে বা প্রান্তিক করতে পারে না। সবচেয়ে ভাল থাকা যায় নিজের সঙ্গে নিজে একটা সৎ এবং সহৃদয় সম্পর্কে থাকলে। কেন যে আমরা সবসময় বাইরে থেকে ‘ভ্যালিডেশন’ চাই! কেন যে বহির্জগতের অনুমোদন চাই! সেই ‘বৈধতা’ যে মনোমুগ্ধকর, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু কী জানেন? নিজের সঙ্গে নিজের সৎ, সহৃদয় সম্পর্কের চেয়ে দামি আর কিছু হতে পারে না। তখন বাকি আর কিছু না থাকলেও চলে। সত্যিই।

ওইজন্যই আয়নায় রোজ নিজেকে বলা, চল্! কোনও ব্যাপার না। দুনিয়া চুলোয় যাক! আমি আছি তোর সঙ্গে!

সম্পাদকীয় :

Publisher & Editor :Md. Abu Hena Mostafa Zaman

Mobile No: 01971- 007766; 01711-954647

রাজশাহীর সময় অনলাইন নিউজ পোর্টাল আবেদনকৃত চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর, ঢাকা ।

অফিস :

Head office: 152- Aktroy more ( kazla)-6204 Thana : Motihar,Rajshahi

Email : [email protected],                    [email protected]