এয়ারপোর্ট থানার ওসি ফারুক হোসেন এর বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃতভাবে দুর্বল ধারা বসানোর অভিযোগ, আইনের শিথিলতা ও রাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে জনমনে প্রশ্ন।

হিমাগারে পিন ফুটিয়ে নির্যাতন’: দুর্বল ধারায় জামিন, প্রশ্ন পুলিশের ভূমিকায়

আপলোড সময় : ০৯-১০-২০২৫ ০৯:৪৬:৩১ পূর্বাহ্ন , আপডেট সময় : ০৯-১০-২০২৫ ১০:০৬:৫৩ পূর্বাহ্ন
রাজশাহীর পবা উপজেলার বায়া এলাকায় হিমাগারে এক মেডিকেল শিক্ষার্থী ও তার দুই আত্মীয়কে ডেকে নিয়ে নির্মম নির্যাতনের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় তিন আসামি জামিন পেয়েছেন। তবে মামলার ধারায় ‘ইচ্ছাকৃত দুর্বলতা’ রাখায় আদালত থেকে সহজেই জামিন পেয়ে যাওয়ায় জনমনে প্রশ্ন উঠেছে পুলিশের নিরপেক্ষতা ও আইনের প্রয়োগ নিয়ে।

গত মঙ্গলবার (৭ অক্টোবর) সকালে মোহাম্মদ আলী সরকারের মালিকানাধীন সরকার কোল্ড স্টোরেজে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয় এক মেডিকেল শিক্ষার্থী (২৭), তার খালাতো বোন (৩০) ও এক কিশোরীকে (১৩)।
অভিযোগ অনুযায়ী, তাঁদের লাঠি, বাঁশ ও হাতুড়ি দিয়ে পেটানো হয় এবং শরীরে সেফটি পিন ফুটিয়ে নির্যাতন করা হয়।

স্থানীয়রা গুরুতর আহত অবস্থায় তিনজনকে উদ্ধার করে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে।
এই ঘটনার পর বুধবার আসামি আহসান উদ্দিন সরকার জিকো, আঁখি ও হাবিবা-কে গ্রেপ্তার করে পুলিশ আদালতে পাঠায়। কিন্তু এয়ারপোর্ট থানার ওসি ফারুক হোসেন মামলায় ধারা দেন ৩৪২/৩২৩/৩২৫ — যা ‘অবৈধ আটক ও সাধারণ আঘাত’-সংক্রান্ত এবং তুলনামূলকভাবে জামিনযোগ্য।

আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ঘটনায় ব্যবহৃত সেফটি পিনকে “তীক্ষ্ণ অস্ত্র” হিসেবে গণ্য করা উচিত, ফলে দণ্ডবিধির ৩২৬ ধারা (গুরুতর জখম) প্রযোজ্য হতো।
কিন্তু ধারা দুর্বল করায় আদালত বুধবারই তিন আসামির জামিন মঞ্জুর করেন।

রাজশাহী বার অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র আইনজীবী পারভেজ তৌফিক জাহেদী বলেন, “যখন ধারালো অস্ত্র দিয়ে দেহে ছিদ্র করা হয়, তা স্পষ্টভাবে ৩২৬ ধারার মধ্যে পড়ে। দুর্বল ধারা বসানো মানে মামলাকে অগ্রিম দুর্বল করে দেওয়া।”

বাদীর অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধে
মামলার বাদী জনাবুর রহমান বিপুল অভিযোগ করেন, থানার ওসি প্রথমে মামলা না নেওয়ার চেষ্টা করেন।
তিনি বলেন, “ওসি ফারুক হোসেন বলেছিলেন, ‘বিষয়টা মীমাংসা হয়ে যাবে।’ পরে আমি চাপ দিলে পুরনো খসড়াকেই এজাহার বানিয়ে ফেলেন।” মামলার পর থেকেই আসামিপক্ষ এবং কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি তাঁকে মামলা তুলে নিতে প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছেন বলেও জানান জনাবুর রহমান বিপুল।

আসামিপক্ষের রাজনৈতিক প্রভাব
গ্রেপ্তার হওয়া তিনজন রাজশাহী জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ আলী সরকারের সন্তান।
তিনি রাজশাহী চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি এবং দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় রাজনীতির প্রভাবশালী ব্যক্তি।
স্থানীয়দের অভিযোগ, রাজনৈতিক প্রভাবের কারণেই পুলিশ প্রথমে মামলা নিতে অনীহা দেখায় এবং পরে দুর্বল ধারা প্রয়োগ করে মামলা রেকর্ড করে।

ভুক্তভোগীদের অবস্থা
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন তিনজনের শরীরে একাধিক ছিদ্র, কালশিটে দাগ ও মারাত্মক ব্যথা রয়েছে।
বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর) রামেক হাসপাতালের মুখপাত্র ডা. শংকর কে বিশ্বাস জানান, “তিনজনই এখন শঙ্কামুক্ত, তবে তাদের শরীরে নির্যাতনের সুস্পষ্ট চিহ্ন রয়েছে।”

এ বিষয়ে এয়ারপোর্ট থানার অফিসার ইনচাজ (ওসি) ফারুক হোসেন এর কাছে জানতে চাইলে তিনি সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “যা ঘটেছে তার ভিত্তিতেই ধারা দেওয়া হয়েছে। দুর্বল ধারা বসানোর কোনো উদ্দেশ্য ছিল না।”
সেফটি পিনকে “ভোতা অস্ত্র” হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এটার জন্য আলাদা কোনো ধারা নেই।”

রাজশাহী মহানগর পুলিশের (আরএমপি) উপ-পুলিশ কমিশনার গাজিউর রহমান আলোচিত ঘটনাটি নিয়ে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। তিনি নিশ্চিত করেছেন যে, এই বিষয়ে ইতিমধ্যেই একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে এবং অভিযুক্ত আসামিদেরকে বিজ্ঞ আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে।
'সেফটি পিন' ও আইনগত ধারা প্রসঙ্গে:
নির্যাতনের ক্ষেত্রে 'সেফটি পিন'-এর ব্যবহার দণ্ডবিধির ৩২৬ ধারার আওতায় পড়বে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সাধারণত সেফটি পিনকে 'মারাত্মক' বা 'প্রাণঘাতী (Lethal) অস্ত্র' হিসেবে গণ্য করা হয় না। এই কারণেই প্রাথমিকভাবে এই ধারায় মামলা রুজু করা হয়নি।
তবে তিনি উল্লেখ করেন যে, এই ধারাটি পরিবর্তনের সুযোগ রয়েছে। যদি চিকিৎসার দায়িত্বে থাকা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের মেডিকেল রিপোর্টে সেফটি পিন দ্বারা করা আঘাতকে 'গুরুতর' বলে মনে করেন, তবে মামলায় ৩২৬ ধারা বা প্রযোজ্য অন্যান্য ধারা সংযুক্ত হতে পারে। এটি চূড়ান্ত অভিযোগপত্রে (Final Charge Sheet) সংশোধন হওয়ার সুযোগ রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, এই বিষয়ে বাদী পক্ষ যদি কোনো অতিরিক্ত অভিযোগ বা কোনো অসঙ্গতির বিষয় নিয়ে নতুন করে অভিযোগ করেন, তবে সেই অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত সাপেক্ষে কঠোরতম ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তিনি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন, "যদি এই ঘটনার সঙ্গে পুলিশের কোনো সদস্যের জড়িত থাকার প্রমাণও পাওয়া যায়, তবুও তাকে কোনো প্রকার ছাড় দেওয়া হবে না।"

সামাজিক প্রতিক্রিয়া ও জনমতের প্রভাব
এই ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।
রাজশাহীর অধিবাসীরা প্রশ্ন তুলেছেন—
“যদি প্রভাবশালী পরিবারের সন্তানদের জন্য আইন দুর্বল হয়, তাহলে সাধারণ মানুষ ন্যায়বিচার পাবে কোথায়?”
মানবাধিকার সংগঠন অধিকার ও বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) বলছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এমন ‘দুর্বল ধারা বসানো’ ও ‘প্রভাব খাটানো’ মামলার সংখ্যা বেড়েছে, যা পুলিশের ওপর জনআস্থার সংকট তৈরি করছে।

তাদের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—
🔸 গত দুই বছরে ৪৭টি আলোচিত মামলায় প্রথম এফআইআরে প্রমাণ থাকলেও পরবর্তীতে ধারা পরিবর্তন বা দুর্বল ধারা সংযোজন করা হয়েছে।
🔸 এর মধ্যে ৩৫টি ক্ষেত্রে আসামিরা প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ধারা নির্ধারণই মামলার ভবিষ্যৎ দিক নির্ধারণ করে।
ভুল বা দুর্বল ধারা প্রয়োগ মানে আসামির আগাম সুবিধা নিশ্চিত করা। তাদের মতে, এটি শুধু একটি মামলার বিষয় নয়— এটি বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় ন্যায়বিচারের প্রতি মানুষের বিশ্বাসকে গভীরভাবে আঘাত করছে।

সম্পাদকীয় :

Publisher & Editor :Md. Abu Hena Mostafa Zaman

Mobile No: 01971- 007766; 01711-954647

রাজশাহীর সময় অনলাইন নিউজ পোর্টাল আবেদনকৃত চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর, ঢাকা ।

অফিস :

Head office: 152- Aktroy more ( kazla)-6204 Thana : Motihar,Rajshahi

Email : [email protected],                    [email protected]