​পদ্মার ঘাটে জিম্মি হাজারো মানুষ: অতিরিক্ত টোলে দিশেহারা চরাঞ্চলের বাসিন্দারা

আপলোড সময় : ০২-১০-২০২৫ ০৫:৩৫:১৭ অপরাহ্ন , আপডেট সময় : ০২-১০-২০২৫ ০৫:৩৫:১৭ অপরাহ্ন
বাবার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে ঢাকা থেকে দ্রুত চাঁপাইনবাবগঞ্জে ছুটে এসেছিলেন হানিফ আলী। প্রায় ৩২০ কিলোমিটার পথ ৯ ঘণ্টায় নির্বিঘ্নে পাড়ি দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু পদ্মা নদীর ঘাটে এসে থমকে যায় তার যাত্রা। খেয়াঘাটের ইজারাদার ও মাঝিরা নৌকা ভর্তি না হলে ছাড়তে নারাজ। এমনকি একজন যাত্রী ও একটি ব্যাগের জন্য ৬ হাজার টাকা ভাড়া দাবি করা হয়। বাবার জানাজা আটকে ছিল শুধু তার জন্য, অথচ নদীর ৩০ টাকার পথ পাড়ি দিতে তাকে ২ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছিল। হানিফ আলীর মতো হাজার হাজার চরাঞ্চলের বাসিন্দা প্রতিনিয়ত এমন দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। অতিরিক্ত টোল আদায় এবং ইজারাদারদের স্বেচ্ছাচারিতায় তারা রীতিমতো জিম্মি হয়ে পড়েছেন পদ্মার খেয়াঘাটগুলোতে।

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ফারাক্কার ভাটিতে ভারত থেকে আসা অতিরিক্ত পানির প্রভাবে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর ও শিবগঞ্জ উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নের প্রায় ১১ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। দফায় দফায় পানি বাড়া-কমার ফলে নদী তীরবর্তী এলাকায় তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ভারতীয় সীমান্তবর্তী চরাঞ্চলের বাসিন্দাদের নতুন ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে পদ্মা নদীর খেয়াঘাটগুলো। ইজারাদারদের বিরুদ্ধে নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে জোরপূর্বক টোল আদায়ের অভিযোগ উঠেছে। এমনকি এক কেজি বেগুন, একটি ডাব, কিংবা একটি গাছের চারা পারাপারের জন্যও টোল দিতে হচ্ছে। চাহিদামতো টোল পরিশোধ না করতে পারলে আটকে রাখা হচ্ছে মালামাল ও মরদেহ। একদিকে বারবার বাড়ি ভেঙে নিঃস্ব হচ্ছে পদ্মাপাড়ের মানুষ, অন্যদিকে ইজারাদারদের গলাকাটা টোল আদায় তাদের জন্য 'গলার কাঁটা' হয়ে দাঁড়িয়েছে।

স্থানীয়রা জানান, ইজারাদারদের যোগসাজশে নদীতে নৌকার সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। উপজেলা প্রশাসনের কাছ থেকে ইজারা নিয়ে নিয়ম বহির্ভূতভাবে ইজারাদাররা পুনরায় ইজারা দেয়, যার ফলে হাতবদল হওয়ায় যাত্রীদের অতিরিক্ত ভাড়া গুনতে হয়। মরদেহ পারাপারের জন্যও হাজার হাজার টাকা দিতে হয়। এ বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসনকে একাধিকবার জানিয়েও কোনো প্রতিকার মেলেনি বলে অভিযোগ তাদের।

নারায়নপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা তারেক রহমান বলেন, "আমাদের দিকে দেখার কেউ নেই। একজন মানুষ পারাপারে ৩০ টাকার জায়গায় ৪০ টাকা নেওয়া হয়, অথচ একটি আটার বস্তায় নেওয়া হয় ৫০ টাকা। একটি ডাব, গাছের চারা নিয়ে গেলেও তার ভাড়া দিতে হয়। এ নিয়ে দর কষাকষি করতে গেলেই নৌকা থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়। উপায় না পেয়ে বাধ্য হয়েই যেতে হয়।" তিনি অভিযোগ করেন যে, স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত থাকায় কোনো সুরাহা হচ্ছে না।
ষাটোর্ধ্ব তরিকুল ইসলাম তার জামাইয়ের মৃত্যুর পর জানাজায় যাওয়ার অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে বলেন, "ঘাটে গেলে পড়তে হয় বিপত্তিতে। তাদেরকে বারবার জানাজার কথা বললেও নৌকা ছাড়ে না। উল্টো জানায় ৫-৬ হাজার টাকা না দিলে অথবা লোক ভর্তি না হলে নৌকা ছাড়া হবে না। তিনি আরও বলেন, ভাঙনের সময়ে ঘরবাড়ি ভেঙে আশ্রয় নেওয়া অসহায় মানুষদের প্রতিও ইজারাদাররা নির্দয় আচরণ করে। একটি বাড়ির মালপত্র নিয়ে যেতে ৪-৬ হাজার টাকা ভাড়া নেয়।

অনেক পদ্মাপাড়ের বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, অতিরিক্ত ভাড়া দিতে অস্বীকৃতি জানালে তাদের হুমকি ও ভয়ভীতি দেখানো হয়। তারা বলেন, পুলিশ, সেনাবাহিনী, ইউএনও, উপজেলা চেয়ারম্যান - সবাইকে তাদের দুর্দশার কথা জানানো হয়েছে, কিন্তু কেউ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এমনকি এত অভিযোগের পরেও ঘাটে ভাড়ার তালিকা পর্যন্ত টানানো হয়নি। উল্টো অভিযোগ দেওয়ায় অনেককে মারধরের হুমকি দেওয়া হয়েছে।

কৃষক শফিকুল ইসলাম বলেন, অতিরিক্ত ভাড়া দিয়েও নিরাপদে পদ্মা নদী পার হতে পারি না। অতিরিক্ত লোক তোলার কারণে মাঝেমধ্যেই ঘটে নৌকাডুবির ঘটনা। এসব নৌকাডুবিতে প্রতি বছর প্রাণহানি ঘটে। গরু-ছাগল, যানবাহন ও মানুষ এক নৌকাতেই পার করা হয়। এমন অবস্থা থেকে আমরা মুক্তি চাই।

তিনি অভিযোগ করেন, স্থানীয় প্রশাসনের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী, রাজনৈতিক নেতা ও জনপ্রতিনিধিরা ঘাটের সঙ্গে জড়িত থাকায় বছরের পর বছর এমনভাবে চললেও কোনো প্রতিকার পাওয়া যায় না।

এ বিষয়ে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও ইজারাদাররা ক্যামেরার সামনে কথা বলতে রাজি হননি। অন্যদিকে, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নুরুল ইসলাম জানান, অতিরিক্ত টোল আদায়ের বিষয়ে কয়েকবার অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযোগের বিষয়ে ইজারাদারদের কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে এবং এর পরেও অতিরিক্ত ভাড়া নিলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

উল্লেখ্য, গত বছর শিবগঞ্জ উপজেলায় অতিরিক্ত টোল আদায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে স্থানীয়রা ইজারাদারদের ঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিল। চলতি বছর ভাগরথি জোহরপুর ঘাট ২৯ লাখ ৫০০ টাকা ও বাখের আলী ঘাট ৩৬ লাখ ৩৫ হাজার টাকায় ইজারা দেওয়া হয়েছে।

সম্পাদকীয় :

Publisher & Editor :Md. Abu Hena Mostafa Zaman

Mobile No: 01971- 007766; 01711-954647

রাজশাহীর সময় অনলাইন নিউজ পোর্টাল আবেদনকৃত চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর, ঢাকা ।

অফিস :

Head office: 152- Aktroy more ( kazla)-6204 Thana : Motihar,Rajshahi

Email : [email protected],                    [email protected]