হাজার হাজার পানিবন্দি মানুষ জিম্মি পদ্মার খেয়াঘাট ইজারাদারদের কাছে

আপলোড সময় : ০২-১০-২০২৫ ০২:১৮:২৮ অপরাহ্ন , আপডেট সময় : ০২-১০-২০২৫ ০২:১৮:২৮ অপরাহ্ন
"বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে ঢাকা থেকে দ্রুত বাস ধরে ছুটে আসি চাঁপাইনবাবগঞ্জে। এরপর জেলা শহরের বিশ্বরোড মোড়ে নেমে সেখানেই অটোরিকসা করে যায় পদ্মা নদীর ঘাটে। ঢাকা থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের চরবাগডাঙ্গা পদ্মা নদীর ঘাট প্রায় ৩২০ কিলোমিটার পথে বিনা বাধায় ৯ ঘন্টায় চলে আসি। এদিকে, শুধুমাত্র আমার জন্য আটকে আছে বাবার জানাযা। ৩২০ কিলোমিটার পথ এসে শুধুমাত্র নদী পার হওয়ার জন্যই আটকে যায় ঘাটে। খেয়াঘাটের মাঝি ও ইজারাদারদের বারবার অনুরোধ করলেও নৌকা ভর্তি নয় হলে ছাড়বে না বলে সাফ জানিয়ে দেয়। অন্যথায় ৬ হাজার টাকা ভাড়া চাই একজন মানুষ আর একটা ব্যাগের।"

এমন করুণ দুর্দশার কথা বলছিলেন ঢাকায় রাজমিস্ত্রীর কাজ করা সীমান্তবর্তী পদ্মাপাড়ের চাঁপাইনবাবগঞ্জের নারায়ানপুর ইউনিয়নের নারায়নপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা হানিফ আলী। তিনি আরও বলেন, ঘটনাটি কয়েক মাস আগের ঘটনা। শেষমেষ আমিসহ আরও কয়েকজনকে নিয়ে ৩০ টাকার ভাড়ার দুরত্বের জন্য অপেক্ষা করতে হয় ২ ঘন্টা। আমার মতোই পদ্মা নদীর ওপারে বসবাস করা প্রায় সবারই এমন অবস্থা। হাজার হাজার মানুষ রীতিমত জিম্মি পদ্মানদীর খেয়াঘাটের ইজারাদারদের কাছে। 

জানা যায়, ফারাক্কার ভাটিতে ভারত থেকে আসা অতিরিক্ত পানির প্রভাবে প্রায় দেড় মাস ধরে পানিবন্দি চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর ও শিবগঞ্জ উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নের প্রায় ১১ হাজার পরিবার। এরমধ্যে কয়েকদিন পরপর দফায় দফায় পানি কমছে ও বাড়ছে। প্রমত্তা পদ্মায় পানি কমলে বা বাড়লেই নদী তীরবর্তী এলাকায় দেখা যায় তীব্র ভাঙন। এমন পানিবন্দি ও ভাঙনের অবস্থাতে ভারতীয় সীমান্তবর্তী চরাঞ্চলের বাসিন্দাদের নতুন ভোগান্তি পদ্মা নদীতে থাকা খেয়াঘাটগুলো। এসব খেয়াঘাটে নেয়া হচ্ছে অতিরিক্ত ভাড়া। 

খেয়াঘাট ইজারাদারদের বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ, নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে জোরপূবর্ক টোল আদায় করা হচ্ছে। এক কেজি বেগুন, একটি ডাব, কিংবা একটি গাছেরও টোল আদায় করছে তারা। এমনকি চাহিদামতো টোলের টাকা পরিশোধ না করতে পারলে আটকে রাখা হয় মালামাল ও মরদেহ। একদিকে, বার বার বাড়ি ভাঙতে গিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে পদ্মাপাড়ের মানুষ, অপরদিকে গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে ইজারাদারদের গলাকাটা টোল আদায়। 

স্থানীয়রা বলছেন, ইজারাদারদের যোগসাজশে নদীতে নৌকার সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। উপজেলা প্রশাসনের কাছ থেকে ইজারা নিয়ে নিয়ম বর্হিভূতভাবে ইজারাদার পুনরায় ইজারা দেয়। ফলে হাতবদল হওয়ায় অতিরিক্ত ভাড়া গুনতে হয় যাত্রীদের। এমনকি ইজারাদাররা বাধ্য করে একটি ডাবেরও টোল নিচ্ছে। এছাড়া মরদেহ পারপারেও গুনতে হয় হাজার হাজার টাকা। বিষয়গুলো স্থানীয় প্রশাসনকে একাধিকবার জানিয়েও প্রতিকার মেলেনি।

সদর উপজেলার নারায়নপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা তারেক রহমান জানান, আমাদের দিকে দেখার কেউ নেই। একটা মানুষ পারাপারে ৩০ টাকার জায়গায় নেয়া হয় ৪০ টাকা। অথচ একটি আটার বস্তায় নেয়া হয় ৫০ টাকা। একটি ডাব, গাছের চারা নিয়ে গেলেও তার ভাড়া দিতে হয়। এনিয়ে দর কষাকষি করতে গেলেই নৌকা থেকে নামিয়ে দেয়া হয়। উপায় না পেয়ে বাধ্য হয়েই যেতে হয়। এনিয়ে স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের বারবার বললেও কোন সুরাহা হয়নি। কারন তারাও এই সিন্ডিকেটের সাথে জড়িত। 

ষাটোর্ধ তরিকুল ইসলাম বলেন, কয়েকদিন আগে আমার এক জামাই মারা যায়। তাকে দেখতে জানাযায় যাওয়ার জন্য ঘাটে গেলে পড়তে হয় বিপত্তিতে। তাদেরকে বারবার জানাযার কথা বললেও নৌকা ছাড়ে না। উল্টো জানায় ৫-৬ হাজার টাকা না দিলে অথবা লোক ভর্তি না হলে নৌকা ছাড়া হবে না। এখন ভাঙনের সময়, এসময়ে অনেকেই ঘরবাড়ি ভেঙে আরেক জায়গায় আশ্রয় নেয়। এমন মানুষদের প্রতিও নির্দয় ইজারাদাররা। একটি বাড়ির মালপত্র নিয়ে যেতে ৪-৬ হাজার টাকা ভাড়া নেয়। 

অতিরিক্ত ভাড়া দিতে অস্বীকৃতি জানালে হুমকি ও ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগ করেন পদ্মাপাড়ের বাসিন্দাদের অনেকেই। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন জানান, এমন কোন জায়গা নেই, যেখানে অভিযোগ দেয়া হয়নি। পুলিশ, সেনাবাহিনী, ইউএনও, উপজেলা চেয়ারম্যান সবাইকে বলা হয়েছে আমাদের দুর্দশার কথা। কিন্তু কেউ কোন ব্যবস্থা নেয়নি। এমনকি এত অভিযোগের পরেও ঘাটে ভাড়ার তালিকা পর্যন্ত টানানো হয়নি৷ উল্টো অভিযোগ দেয়ায়, মারধরের হুমকি দেয়া হয় অনেককেই। 

কৃষক শফিকুল ইসলাম বলেন, অতিরিক্ত ভাড়া দিয়েও নিরাপদে পদ্মা নদী পার হতে পারিনা। অতিরিক্ত লোক তোলার কারনে মাঝেমধ্যেই ঘটে নৌকাডুবির ঘটনা। এসব নৌকাডুবিতে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে প্রতিবছর। গরু-ছাগল, যানবহন ও মানুষ এক নৌকাতেই পার করা হয়। এমন অবস্থা থেকে আমরা মুক্তি চাই। স্থানীয় প্রশাসনের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী, রাজনৈতিক নেতা ও জনপ্রতিনিধিরা ঘাটের সাথে জড়িত থাকায় দিনের পর দিন বছরের পর বছর এমনভাবে চলতে থাকলেও কোন প্রতিকার পায়না। 

এবিষয়ে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও ক্যামেরার সামনে কথা বলতে রাজি হননি ইজারাদাররা। অন্যদিকে, অতিরিক্ত টোল আদায়ের বিরুদ্ধে তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানান উপজেলা প্রশাসন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নুরুল ইসলাম বলেন, অতিরিক্ত টোল আদায়ের বিষয়ে কয়েকবার অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযোগের বিষয়ে ইজারাদারদের কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এরপরেও অতিরিক্ত ভাড়া নিলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। 

গতবছর অতিরিক্ত টোল আদায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে শিবগঞ্জ উপজেলায় ইজারাদারদের ঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় স্থানীয়রা। চলতি বছর ভাগরথি জোহরপুর ঘাট ২৯ লাখ ৫০০ টাকা ও বাখের আলী ঘাট ৩৬ লাখ ৩৫ হাজার টাকায় ইাজারা দেয়া হয়।

সম্পাদকীয় :

Publisher & Editor :Md. Abu Hena Mostafa Zaman

Mobile No: 01971- 007766; 01711-954647

রাজশাহীর সময় অনলাইন নিউজ পোর্টাল আবেদনকৃত চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর, ঢাকা ।

অফিস :

Head office: 152- Aktroy more ( kazla)-6204 Thana : Motihar,Rajshahi

Email : [email protected],                    [email protected]