
সকালের কুয়াশায় ঢাকা বনকিশোর গ্রামের একটা ছোট বাড়ির আঙিনায় বসে আছেন শ্রীমতি রানী, চোখে অশ্রু আর মুখে নীরবতা। গত মঙ্গলবার রাতে তার একমাত্র ছেলে মিঠুন দাস (২৮) চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে চলন্ত ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। ফেসবুক লাইভে তার শেষ কথা: “ঋণের চাপে পরিবারকে শেষ হতে দেখতে পারছি না। সরকার, ঋণমুক্ত করে দিন।” মিঠুনের মৃত্যু শুধু একটা পরিবারের শোক নয়, এটা রাজশাহীর গ্রামীণ সমাজের একটা ভয়াবহ সংকটের প্রতীক, যেখানে সুদের জাল আর এনজিওর ক্ষুদ্রঋণের চাপে যুবক থেকে কৃষক পর্যন্ত আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে।
এই প্রতিবেদনের মূল সন্ধান: ২০২৫ সালের প্রথম নয় মাসে রাজশাহীসহ চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নাটোরে ঋণের চাপে কমপক্ষে ২০ জনের আত্মহত্যা ঘটেছে, যার মধ্যে ৮ জন কৃষক এবং ৫ জন যুবক। স্থানীয় সুদখোরদের অত্যাচার (মাসিক ১০০ টাকা হাজারে সুদ, বার্ষিক ১২০%) এবং এনজিওর ক্ষুদ্রঋণের কঠোর কিস্তি (মাসিক ১০-১৫% সুদ) গ্রামীণ জীবনকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। একটি দৈনিক ইন্ডাস্ট্রি তদন্তে দেখা গেছে, এনজিও ব্যুরোর তথ্য অনুসারে বাংলাদেশে ২,০১৮টি এনজিওর ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি তিন কোটি মানুষকে প্রভাবিত করছে, কিন্তু সুদের চাপে এটা ‘দারিদ্র্যের চক্র’ তৈরি করেছে—যা আত্মহত্যার হার ২০% বাড়িয়েছে। রাজশাহীতে গত তিন মাসে ১০ জনের মৃত্যু, যার মধ্যে পবা উপজেলায় একই পরিবারের ৪ জন (মিনারুলের পরিবার) ঋণের হয়রানিতে আত্মহত্যা করেছে।
সুদের জাল ও এনজিওর ছায়া: গ্রামীণ অর্থনীতির কালো ছবি
রাজশাহীর গ্রামে সুদের অত্যাচার একটা সিস্টেম্যাটিক ফাঁদ। দ্য ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিম্ন আয়ের মানুষরা জরুরি প্রয়োজনে এনজিওর ঋণ নেয়, কিন্তু উচ্চ সুদ (মাসিক ১০-১৫%) এবং কঠোর কিস্তি তাদের ফাঁসে ফেলে। উদাহরণস্বরূপ, মোহনপুরের খাড়ইল গ্রামে আকবর হোসেন (৫০) ১১টি এনজিও থেকে ৪ লাখ টাকা নেন পান বরজের জন্য, কিন্তু দাম পড়ায় কিস্তি দেওয়া যায় না। এনজিও কর্মীরা রাতে হয়রানি করে, মামলা করে, ফলে ১৮ আগস্ট আকবর ফাঁস লাগান। একইভাবে, পাবার বামনশিকড়ে ১৫ আগস্ট হারুন সরকার (৪০) ৩ লাখ টাকা সুদে নিয়ে স্ত্রী-ছেলে-মেয়েকে হত্যা করে নিজে আত্মহত্যা করেন। ডিডব্লিউ’র তদন্তে দেখা গেছে, এনজিওগুলো ঋণ দেওয়ার আগে পরিবারের আয় খতিয়ে দেখে না, ফলে একই পরিবারে একাধিক ঋণ হয়, যা বার্ষিক ১২০% সুদে বাড়ে। জুগান্তর’র জরিপে ৫ দিনে ১১ জনের আত্মহত্যা, যার ৮ জন কৃষক। হয়রানির কারণে ৩০% পরিবার বাড়িঘর ফেলে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এনজিওর ক্ষুদ্রঋণ ‘দারিদ্র্যমোচন’ হওয়ার বদলে কৃষি উৎপাদন ৩.৫৪% কমিয়ে মানসিক স্বাস্থ্যের সংকট বাড়াচ্ছে।
পরিবারের কান্না: ঋণের ছায়ায় নিভে যাওয়া স্বপ্ন
মিঠুনের মৃত্যুর পর বনকিশোরের বাড়িতে শ্রীমতি রানী (৫৫) বলেন, “আমার গয়না বন্ধক রেখে ৫০ হাজার দিয়েছিলাম, মাসে ১০ হাজার সুদ। ছেলে ওষুধ কোম্পানিতে যোগ দিলেও তিন লাখ চুরি হয়ে গেল। এখন কে চালাবে? বাপ অসুস্থ, বিউটির সাথে কী হবে?” স্ত্রী বিউটি (২৫) নির্বাক: “শেষ ফোনে বলল, ‘চট্টগ্রামে ব্যস্ত।’” আকবরের ছেলে সুজন (২৫) বলেন, “বাবার মৃত্যুর পরও এনজিও কিস্তি চায়। পান বরজ চালাতে গিয়ে জমি বিক্রি করতে হবে।” পাবার হারুনের পরিবারের এক প্রতিবেশী বলেন, “সুদখোররা রাতে দরজায় হাতুড়ি মারতো। চারজন একসাথে মারা গেলেন, ঋণের ভয়ে।” এসব গল্প রাজশাহীর গ্রামে সাধারণ: ৩০% ঋণগ্রস্ত পরিবার মানসিক চাপে ভুগছে, যা আত্মহত্যার হার বাড়িয়েছে। মিঠুনের মতো যুবকরা ব্যবসা করে উঠতে চেয়ে সুদের ফাঁদে পড়ে পরিবারকে ধ্বংসের মুখে ফেলে যাচ্ছেন।
যখন রাজশাহীর গ্রামগুলো ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ছে, প্রশ্ন ওঠে, কখন এই চক্র ভাঙবে? সচেতনতার জন্য স্থানীয় এনজিও এবং সরকারের সহযোগিতায় আর্থিক সাক্ষরতা প্রশিক্ষণ চালানো দরকার, যাতে লোকেরা ঋণ নেওয়ার আগে ঝুঁকি বোঝে। সমাধানের উপায়: সরকারের ঋণমুক্তি প্রকল্প (যেমন কৃষকদের জন্য ১ লাখ টাকা পর্যন্ত মওকুফ) বাড়ানো, এনজিও নিয়ন্ত্রণ আইন কঠোর করা (সুদের হার ১০% এ নামানো), এবং স্থানীয় হেল্পলাইন (যেমন মানসিক স্বাস্থ্য হটলাইন ১৬২৬৩) প্রচার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কমিউনিটি-ভিত্তিক সঞ্চয় গ্রুপ গড়ে তোলা এবং সরকারি ব্যাঙ্কের কম সুদের ঋণ সহজলভ্য করলে এই সংকট কমবে। কিন্তু আকবর-মিঠুনের মতো কত কৃষক আর অপেক্ষা করবেন? এই অন্ধকার অধ্যায় শেষ না হওয়া পর্যন্ত, প্রতিটি আত্মহত্যা হবে একটা চিৎকার, যা শুনতে হবে, না হলে আরও অনেক পরিবার ধ্বংস হবে।
এই প্রতিবেদনের মূল সন্ধান: ২০২৫ সালের প্রথম নয় মাসে রাজশাহীসহ চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নাটোরে ঋণের চাপে কমপক্ষে ২০ জনের আত্মহত্যা ঘটেছে, যার মধ্যে ৮ জন কৃষক এবং ৫ জন যুবক। স্থানীয় সুদখোরদের অত্যাচার (মাসিক ১০০ টাকা হাজারে সুদ, বার্ষিক ১২০%) এবং এনজিওর ক্ষুদ্রঋণের কঠোর কিস্তি (মাসিক ১০-১৫% সুদ) গ্রামীণ জীবনকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। একটি দৈনিক ইন্ডাস্ট্রি তদন্তে দেখা গেছে, এনজিও ব্যুরোর তথ্য অনুসারে বাংলাদেশে ২,০১৮টি এনজিওর ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি তিন কোটি মানুষকে প্রভাবিত করছে, কিন্তু সুদের চাপে এটা ‘দারিদ্র্যের চক্র’ তৈরি করেছে—যা আত্মহত্যার হার ২০% বাড়িয়েছে। রাজশাহীতে গত তিন মাসে ১০ জনের মৃত্যু, যার মধ্যে পবা উপজেলায় একই পরিবারের ৪ জন (মিনারুলের পরিবার) ঋণের হয়রানিতে আত্মহত্যা করেছে।
সুদের জাল ও এনজিওর ছায়া: গ্রামীণ অর্থনীতির কালো ছবি
রাজশাহীর গ্রামে সুদের অত্যাচার একটা সিস্টেম্যাটিক ফাঁদ। দ্য ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিম্ন আয়ের মানুষরা জরুরি প্রয়োজনে এনজিওর ঋণ নেয়, কিন্তু উচ্চ সুদ (মাসিক ১০-১৫%) এবং কঠোর কিস্তি তাদের ফাঁসে ফেলে। উদাহরণস্বরূপ, মোহনপুরের খাড়ইল গ্রামে আকবর হোসেন (৫০) ১১টি এনজিও থেকে ৪ লাখ টাকা নেন পান বরজের জন্য, কিন্তু দাম পড়ায় কিস্তি দেওয়া যায় না। এনজিও কর্মীরা রাতে হয়রানি করে, মামলা করে, ফলে ১৮ আগস্ট আকবর ফাঁস লাগান। একইভাবে, পাবার বামনশিকড়ে ১৫ আগস্ট হারুন সরকার (৪০) ৩ লাখ টাকা সুদে নিয়ে স্ত্রী-ছেলে-মেয়েকে হত্যা করে নিজে আত্মহত্যা করেন। ডিডব্লিউ’র তদন্তে দেখা গেছে, এনজিওগুলো ঋণ দেওয়ার আগে পরিবারের আয় খতিয়ে দেখে না, ফলে একই পরিবারে একাধিক ঋণ হয়, যা বার্ষিক ১২০% সুদে বাড়ে। জুগান্তর’র জরিপে ৫ দিনে ১১ জনের আত্মহত্যা, যার ৮ জন কৃষক। হয়রানির কারণে ৩০% পরিবার বাড়িঘর ফেলে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এনজিওর ক্ষুদ্রঋণ ‘দারিদ্র্যমোচন’ হওয়ার বদলে কৃষি উৎপাদন ৩.৫৪% কমিয়ে মানসিক স্বাস্থ্যের সংকট বাড়াচ্ছে।
পরিবারের কান্না: ঋণের ছায়ায় নিভে যাওয়া স্বপ্ন
মিঠুনের মৃত্যুর পর বনকিশোরের বাড়িতে শ্রীমতি রানী (৫৫) বলেন, “আমার গয়না বন্ধক রেখে ৫০ হাজার দিয়েছিলাম, মাসে ১০ হাজার সুদ। ছেলে ওষুধ কোম্পানিতে যোগ দিলেও তিন লাখ চুরি হয়ে গেল। এখন কে চালাবে? বাপ অসুস্থ, বিউটির সাথে কী হবে?” স্ত্রী বিউটি (২৫) নির্বাক: “শেষ ফোনে বলল, ‘চট্টগ্রামে ব্যস্ত।’” আকবরের ছেলে সুজন (২৫) বলেন, “বাবার মৃত্যুর পরও এনজিও কিস্তি চায়। পান বরজ চালাতে গিয়ে জমি বিক্রি করতে হবে।” পাবার হারুনের পরিবারের এক প্রতিবেশী বলেন, “সুদখোররা রাতে দরজায় হাতুড়ি মারতো। চারজন একসাথে মারা গেলেন, ঋণের ভয়ে।” এসব গল্প রাজশাহীর গ্রামে সাধারণ: ৩০% ঋণগ্রস্ত পরিবার মানসিক চাপে ভুগছে, যা আত্মহত্যার হার বাড়িয়েছে। মিঠুনের মতো যুবকরা ব্যবসা করে উঠতে চেয়ে সুদের ফাঁদে পড়ে পরিবারকে ধ্বংসের মুখে ফেলে যাচ্ছেন।
যখন রাজশাহীর গ্রামগুলো ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ছে, প্রশ্ন ওঠে, কখন এই চক্র ভাঙবে? সচেতনতার জন্য স্থানীয় এনজিও এবং সরকারের সহযোগিতায় আর্থিক সাক্ষরতা প্রশিক্ষণ চালানো দরকার, যাতে লোকেরা ঋণ নেওয়ার আগে ঝুঁকি বোঝে। সমাধানের উপায়: সরকারের ঋণমুক্তি প্রকল্প (যেমন কৃষকদের জন্য ১ লাখ টাকা পর্যন্ত মওকুফ) বাড়ানো, এনজিও নিয়ন্ত্রণ আইন কঠোর করা (সুদের হার ১০% এ নামানো), এবং স্থানীয় হেল্পলাইন (যেমন মানসিক স্বাস্থ্য হটলাইন ১৬২৬৩) প্রচার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কমিউনিটি-ভিত্তিক সঞ্চয় গ্রুপ গড়ে তোলা এবং সরকারি ব্যাঙ্কের কম সুদের ঋণ সহজলভ্য করলে এই সংকট কমবে। কিন্তু আকবর-মিঠুনের মতো কত কৃষক আর অপেক্ষা করবেন? এই অন্ধকার অধ্যায় শেষ না হওয়া পর্যন্ত, প্রতিটি আত্মহত্যা হবে একটা চিৎকার, যা শুনতে হবে, না হলে আরও অনেক পরিবার ধ্বংস হবে।