ইরানি সিংহ নারী সাহার ইমামি

আপলোড সময় : ০১-০৭-২০২৫ ০৯:১৪:৫৫ অপরাহ্ন , আপডেট সময় : ০১-০৭-২০২৫ ০৯:১৪:৫৫ অপরাহ্ন
সাহার ইমামি। নামটা এরইমধ্যে বিশ্বব্যাপী ভাইরাল হয়ে গেছে। কারণ ইরানের জাতীয় সম্প্রচার সংস্থা (আইআরআইবি)’র প্রধান ড. পেইমন জেবেলি’র অফিসে যখন ইসরাইল হামলা চালায় তখন ইরানি টিভি চ্যানেল-সিক্সের লাইভ সম্প্রচার চলছিল। চ্যানেলটির লাইভ ব্রডকাস্টিং ওই ভবন থেকেই হতো। সাহার ইমামি ওই চ্যানেলের একজন নিউজ প্রেজেন্টার। তিনি সে সময় লাইভ প্রোগ্রামে। হামলার শব্দ শুনেও তিনি তার উপস্থাপনার টেবিল ছেড়ে ওঠেননি। উলটো আল্লাহু আকবার স্লোগানে স্লোগানে ইসরাইলবিরোধী চেতনার বার্তা পৌঁছে দিয়েছিলেন বিশ্বময়। তার দুর্দান্ত সাহসিতার বীরত্বগাঁথা বিশ্বমানবতার মনের দেওয়ালে দেওয়ালে লেখা হয়ে গেছে। 

টেলিভিশন উপস্থাপক সাহার ইমামি বহু বছর ধরেই ইরানের রাষ্ট্রীয় রেডিও এবং টেলিভিশনে কাজ করছেন। বয়স ৩৯ বছর। ১৬ জুন, ২০২৫ তারিখে যখন ইসরাইল ইরানি রেডিও এবং টেলিভিশন ভবনে আক্রমণ করে, বিশ্বব্যাপী দর্শকরা দেখেছে সাহার ইমামি ইসরাইলি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা এবং উদ্ভূত সংকটময় পরিস্থিতি সত্ত্বেও অনুষ্ঠানটি বন্ধ করেননি। তার সহকর্মীরা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীরা তাকে তাই উপাধি দিয়েছে : ‘শির-যানে ইরানি’ বাংলায় ‘ইরানি সিংহ রমনী’। শির মানে সিংহ আর যান অর্থ নারী। 

আমার অফিস ড. জেবেলির অফিস থেকে ১৫/২০ মিটার দূরত্বে। হামলার আগেভাগে আমাদের নোটিশ করা হয়েছিল অনতিবিলম্বে কমপ্লেক্সের বাইরে চলে যেতে। আমরা তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে পড়লাম। কেউ কেউ স্যান্ডেল পায়েই বেরিয়ে পড়তে বাধ্য হয়েছেন। আমার উত্তমাংশকে বলেছিলাম ঘটনাটা। সে দ্রুত গাড়ি নিয়ে চলে এলো এবং আমরা বাসার উদ্দেশে রওনা হলাম। সাধারণত অফিসের গাড়িতেই আমাদের আনা-নেওয়া করে কিন্তু আজ ওই সার্ভিসের অপেক্ষা করাটা সঙ্গত মনে হয়নি। মিনিট দু’য়েক গাড়ি চলতেই বিকট শব্দে হামলা হলো ড. জেবেলি’র অফিস ভবনে। খুব সুন্দর খোলামেলা ওই ভবনটি কাঁচের চমৎকার ডিজাইন করে বানানো। কাঁচকে ফার্সি ভাষায় বলে শিশে। তাই ওই ভবনটিকে সবাই সখতেমনে শিশে মানে গ্লাস বিল্ডিং নামেই চেনে। সেই গ্লাস বিল্ডিং থেকে কালো ধোঁয়া উড়ছে, আমরা স্লো গতিতে চলমান গাড়ির জানালা খুলে দেখলাম। পরপর কয়েকটি বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেল। ধোঁয়াকে উড়ন্ত রেখেই আমরা দ্রুত চলে গেলাম বাসায়। টিভি অন করতেই দেখি সাহার ইমামি’র লাইভ স্টুডিওতে হামলার ভয়ংকর দৃশ্য। একটুও দমে যাননি এই বীরাঙ্গনা-কী দুঃসাহস রে বাবা! ওই দুঃসাহসের জন্য তিনি ইতোমধ্যে বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কারও পেয়েছেন। নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছে করবে এই মহীয়সী রমনীর কথা। চলুন সংক্ষেপে জানা যাক। 

সাহার ইমামি ১৯৮৫ সালে তেহরানে জন্মগ্রহণ করেন। প্রায় দুই দশক ধরে ইরানি রেডিও এবং টেলিভিশনে খবর ও অনুষ্ঠান উপস্থাপনা পেশায় কাজ করেন তিনি। তিনি অবশ্য পড়ালেখা করেছেন খাদ্য শিল্প নিয়ে। এ বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রিধারী তিনি। 

একজন খাদ্যবিজ্ঞানী যখন সংবাদ উপস্থাপক তখন বোঝাই যাচ্ছে ঘটনাক্রমেই তিনি সম্প্র্রচার মাধ্যমের বিস্তৃত ভুবনে প্রবেশ করেছেন। যেভাবেই এই ভুবনে আসুন না কেন অবশ্যই তিনি এ ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে সফল হয়েছেন। নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছে করছে সাহার ইমামি কীভাবে উপস্থাপক হিসাবে পেশাগত জীবনের সূচনা করেছেন! বলছি!

সাহার ইমামি আইআরআইবিতে (ইসলামিক রিপাবলিক অব ইরানিয়ান ব্রডকাস্টিং) উপস্থাপক পদের জন্য একটি জাতীয় পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন এবং অডিশনের জন্য নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালে তিনি টিভি চ্যানেল ‘তেহরান’ এর ‘উই আর কামিং ব্যাক হোম’ অনুষ্ঠানের তথ্যমূলক অধ্যায়ে ‘জানার আছে’ বিভাগের উপস্থাপক হিসাবে কাজ করেন। চ্যানেল তেহরান’র সামাজিক গোষ্ঠীর সঙ্গে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি।

সাহার ইমামি’র ভাষ্য : ‘আমি ২০০৮ সালের জুন মাসে নিউজ চ্যানেলে যোগ দেই।’ এটাই চ্যানেল সিক্স নামে পরিচিত। ফার্সিতে এই চ্যানেলকে বলা হয় ‘শাবাকে খাবার’। মিসেস ইমামি তখনও ‘উই আর কামিং ব্যাক হোম’ অনুষ্ঠানের তথ্য বিভাগের উপস্থাপক হিসাবে কাজ করছিলেন। সে সঙ্গে সকালের একটি অনুষ্ঠানও করতেন তিনি। সেটি সংবাদ বিষয়ক। নাম ছিল : মর্নিং উইথ নিউজ। তার ভাষ্যমতে উপস্থাপক হিসাবে তার প্রথম কার্যক্রম শুরু হয় একটি লাইভ অনুষ্ঠানে।

সাহার ইমামি বলেন : আইআরআইবি’র নিয়ম অনুযায়ী যারা এ ক্ষেত্রে কাজ করতে চান তাদেরকে প্রথমে প্রোগ্রাম প্রযোজনায় প্রবেশ করতে হয়। তাদের যদি কোনো সমস্যা থাকে তাহলে তা সমাধান করে নিতে হয়। এভাবেই আমি এ ক্ষেত্রে প্রবেশ করি। আমি এতে খুব আগ্রহী ছিলাম বলে অনেক চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালিয়েছি। নিরলস শ্রম দিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করেছি।

সাহার ইমামি কীভাবে সংবাদ উপস্থাপক হলেন, সে বিষয়ে জানা যাক তার বক্তব্য থেকে। তিনি বলেন : যখন আমি নিউজ নেটওয়ার্ক মানে চ্যানেল সিক্সে সোশ্যাল গ্রুপের পরিচালকের কাছে আমার নিউজ প্রেজেন্টেশানের টেস্ট ক্লিপস পাঠাই, তখন থেকে নিউজ নেটওয়ার্কে প্রবেশ করতে প্রায় এক মাস সময় লেগে গিয়েছিল। এই এক মাস আমি খুব কঠিন পরীক্ষা মানে উদ্বেগের মধ্যে ছিলাম। এর আগে আমি চ্যানেল তেহরান-এ স্টুডিও সম্পর্কিত কোনো পরীক্ষা দেইনি।  সে কারণে আমাকে স্টুডিওতে বিভিন্ন রকমের পরীক্ষা দিতে হয়েছিল এবং লাইভ পারফরম্যান্স পরীক্ষাও দিতে হয়েছে। আমার প্রথম অনুষ্ঠান ছিল ‘উই আর কামিং ব্যাক হোম’। এ অনুষ্ঠানে আমি পারফর্ম করেছি বিভিন্ন তথ্যমূলক বিষয় নিয়ে। আমাকে ওই তথ্যগুলো ব্যাখ্যা করতে হতো। কাজটা আমার জন্য একটু কঠিনই ছিল কারণ আমি তথ্যগুলো মুখস্থ করতে চাইতাম। সে কারণে আমি খুব নার্ভাস ছিলাম। খুব ভুল করে ফেলতাম বা এক কথা বারবার বলতে হতো। ধীরে ধীরে যখন নার্ভাসনেস কেটে গেল, নিজের ভুল বুঝতে পারলাম। জড়তা কেটে গেল ধীরে ধীরে। এখন আমি খুব আরামে, অনায়াসে এবং প্রশান্তচিত্তে আমার পারফরমেন্স চালিয়ে যাচ্ছি। ভাবখানা এমন যেন এখন যদি আমি আবারও ভুল করি তবে কিছু যায় আসে না।

সাহার ইমামির পোশাক নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন আপনারা। পোশাক নিয়ে তার ব্যক্তিগত ভাষ্য হলো : আমি গাঢ় রং পছন্দ করি না এবং শহীদ দিবস ছাড়া আমি খুব কমই কালো পোশাক পরি। আমি এমন রং ব্যবহার করি যা নিউজ নেটওয়ার্কের সঙ্গে যায়। উদাহরণস্বরূপ কালো ওড়নাসহ লাল বা হালকা সবুজ ঠিক আছে। কিন্তু যদি আমি ‘উই আর কামিং হোম’ প্রোগ্রামে এগুলো ব্যবহার করতাম, তাহলে তারা বিশ্বাস করত যে এ ধরনের রং শিশুদের দলের সঙ্গেই মানানসই। আমি খুব জমকালো রং নয় বরং উষ্ণ টোনের সঙ্গে প্রফুল­ রং ব্যবহার করি যাতে একটি ফ্যান্টাসি পরিবেশ তৈরি হয়। এখন আমি খুশির রং, আনন্দের রং ব্যবহার করি। কারণ আমার মনে হয় এই রং কেবল আমার কাছেই যে ভালো বোধ হয় তা নয় বরং দর্শকরা, যারা নিউজ নেটওয়ার্কের সোশ্যাল গ্র“প প্রোগ্রাম দেখেন না, তারাও খুশির রং দেখে প্রফুল­ হয়ে উঠবেন, ক্লান্ত শ্রান্ত মনে পরিবর্তন আসবে তাদেরও।

সাহার ইমামি টিভি উপস্থাপকের মেকআপ নিয়েও কথা বলেন। তিনি বলেন : আসলে, প্রতিটি নেটওয়ার্কের পরিচালক মনে করেন যে মেকআপ কেবল মেকআপ এবং কনসিলিং-এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত। উদাহরণস্বরূপ যদি আপনার মুখে ব্রণ বা এরকম কিছু থাকে, তাহলে তা যেন দেখা না যায়-এতটুকুই মেক-আপ করা ভালো। এ বিষয়ে একটি নির্দেশনা রয়েছে। নির্দেশনাটি হলো : যে কোনো ধরনের লিপ লাইনার, আইলাইনার, মাসকারা, লিপস্টিক বা ব্লাশ ব্যবহার নিষিদ্ধ। পার্টিতে আমন্ত্রিত হলে প্রতিটি মহিলা একটি নির্দিষ্ট রুচির পোশাক পরেন এবং নিজেকে সাজাতে ভালোবাসেন। কিন্তু কর্মক্ষেত্রের পোশাক এ ধরনের নয় বরং একদম আলাদা। কারণ প্রতিটি জায়গারই নিজস্ব একটা চাহিদা কিংবা নিয়ম থাকে। আপনাকে বেশ কিছু বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবে। আপনি যখন ইরানি ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনে কাজ করবেন, তখন আপনার দায়িত্ব অনেক বেশি সংবেদনশীল হয়ে ওঠা স্বাভাবিক। কেননা আপনাকে ইরানি ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনের বাইরে থেকেও দেখে দর্শকরা। আপনি সমাজে একজন মিডিয়া প্রতিনিধি হিসাবে উপস্থিত হন। উদাহরণস্বরূপ, টিভিতে একজন মহিলাকে যে ধরনের মেকআপ পরা অবস্থায় দেখা যায়, অন্য জায়গায় তাকে ঘন মেকআপ পরা অবস্থায় দেখতে পাওয়াটা খুবই বিরক্তিকর। অবশ্যই অন্তত তেহরান এবং খবর চ্যানেলে আমার সহকর্মীরা এই বিষয়গুলো মেনে চলে।

সাহার ইমামি বহু বছর ধরে বিবাহিত। আইআরআইবিতে যোগদানের কিছু সময় পর তিনি বিয়ে করেন এবং তার একটি ছেলে সন্তান আছে। তার স্বামীও একজন সাংবাদিক। যাই হোক, সাহার ইমামি সম্পর্কে জানা হলো। তিনি এতো আলোচিত হয়েছেন আইআরআইবি’র প্রধানের কার্যালয় ভবনে ইসরাইলি হামলার কারণে। ওই ভবনের একটি লাইভ স্টুডিওতে হামলা হয়েছিল ১৬ জুন, ২০২৫ তারিখ স্থানীয় সময় বিকাল ৬টার দিকে। আক্রমণের সময় সাহার ইমামি একটি লাইভ অনুষ্ঠান করছিলেন। হামলায় ভবন ধ্বংস হচ্ছে ;তখনও তিনি অনুষ্ঠান চালিয়ে যান। অনুষ্ঠানটি যাতে ব্যাহত না হয় সেই চেষ্টা করেন। যদিও নেপথ্যের কর্মীরা ‘আল­াহু আকবর’ স্লোগান দিয়ে ভবন ছেড়ে যাচ্ছিলেন, সাহার ইমামি তখনও তার পরিবেশনা চালিয়ে যান। 

তিনি লাইভ অনুষ্ঠান এমনভাবে চালাচ্ছিলেন যেন এ ধরনের হামলা কোনো ব্যাপার না, এরকম তো হতেই পারে। তিনি দর্শকদের বলছিলেন : আমাদের সঙ্গে থাকার জন্য আপনাদের ধন্যবাদ। যেমনটি ভাবছেন হ্যাঁ, ইহুদিবাদী আগ্রাসন ইরানের ভ‚মিতে এবং আইআরআইবি কমপ্লেক্সে। যা ভাবছেন তাই, ইরানের রেডিও ও টেলিভিশনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ইহুদিবাদী ইসরাইলি হামলা। (তিনি যখন বলছিলেন তখনও হামলা হচ্ছিলো এবং তার সহকর্মীরা আল­াহু আকবর ধ্বনি তুলে বেরিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু তিনি বসেই ছিলেন।) এবার তরবারির মতো আঙ্গুল তুলে বললেন : আইআরআইবি’র পলিটিক্যাল উইংয়ের কার্যালয়কে আগ্রাসী ইহুদিবাদী ইসরাইল লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। এরপর তিনি আঙ্গুল উঁচিয়ে তিনবার আল­াহু আকবার ধ্বনি তোলেন। নেপথ্যেও সেই ধ্বনি শোনা যাচ্ছিল। সাহার ইমামি লাইভে বললেন : ইরানের প্রিয় জনগণ! জেনে রাখুন! যা কিছু দেখেছেন, যে শব্দ শুনেছেন সেটা আপনাদের প্রিয় জন্মভূমিতে আগ্রাসী ইহুদিবাদী ইসরাইলের হামলার শব্দ। এই হামলা সত্য ও বাস্তবতার কণ্ঠস্বরের ওপর হামলা। যা দেখলেন যা শুনলেন স্টুডিওর ধূলিধূসর ... এতটুকু বলতেই আবারো হামলা। এবার স্টুডিওতে ধ্বংসাবশেষের টুকরো টুকরো ইতিহাসের কণা ঝরে পড়তে দেখে দর্শকরা। চেয়ার ছেড়ে উঠে যেতেই হয় সাহার ইমামিকে।

লেখক পরিচিতি : নাসির মাহমুদ। সিনিয়র সাংবাদিক ও বিশ্লেষক। ওয়ার্ল্ড সার্ভিস, ইরান ব্রডকাস্টিং

সম্পাদকীয় :

Publisher & Editor :Md. Abu Hena Mostafa Zaman

Mobile No: 01971- 007766; 01711-954647

রাজশাহীর সময় অনলাইন নিউজ পোর্টাল আবেদনকৃত চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর, ঢাকা ।

অফিস :

Head office: 152- Aktroy more ( kazla)-6204 Thana : Motihar,Rajshahi

Email : [email protected],                    [email protected]