ইরানের তিন পারমাণবিক কেন্দ্রে মার্কিন হামলা

আপলোড সময় : ২২-০৬-২০২৫ ০৭:৪২:৫৪ অপরাহ্ন , আপডেট সময় : ২২-০৬-২০২৫ ০৭:৪২:৫৪ অপরাহ্ন
ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় আমেরিকান যুদ্ধবিমান বোমা হামলা চালিয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, যা ইরান-ইসরায়েল চলমান সংঘাতের মধ্যে উত্তেজনা কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।

"মনে রাখবেন, এখনও অনেক টার্গেট বাকি। সেগুলোর মধ্যে আজ রাতের টার্গেট ছিল সবচেয়ে কঠিন, আর সম্ভবত সবচেয়ে প্রাণঘাতী," এক সংক্ষিপ্ত টেলিভিশন ভাষণে বলেন মি. ট্রাম্প।

"কিন্তু যদি দ্রুত শান্তি না আসে, আমরা নির্ভুল নিশানা, গতি এবং দক্ষতায় অন্য লক্ষ্যগুলোতেও আঘাত করব।"

শনিবার রাতের হামলার লক্ষ্যগুলোর একটি ছিল ফোর্দো, ইরানের দূরবর্তী পাহাড়ি এলাকার ভেতর লুকানো একটি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র, যা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে ক্ষয়ক্ষতির পূর্ণ মাত্রা এখনও জানা যায়নি।

ইরান আগেই সতর্ক করেছিলো, যেকোনো মার্কিন হামলা আঞ্চলিক যুদ্ধের ঝুঁকি বাড়াবে এবং ইরান এর উচিত জবাব দেবে।

ইরান ইসরায়েল সংঘাত এবং যুক্তরাষ্ট্রের হামলা নিয়ে এখন পর্যন্ত যা জানা যাচ্ছে তার সারসংক্ষেপ দেয়া হলো।

কীভাবে নতুন সংঘাতের শুরু?
গত ১৩ জুন ইরানের কয়েকটি পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে আকস্মিক হামলা চালায় ইসরায়েল।

ইসরায়েলের দাবি, তাদের লক্ষ্য ছিলো ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস করা। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর মতে, এসব কর্মসূচির মাধ্যমে ইরান খুব শিগগিরই পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে সক্ষম হবে। তবে, ইরান বলেছে, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি পুরোপুরি শান্তিপূর্ণ।

এদিকে ইসরায়েলের হামলার জবাবে তেহরানও ইসরায়েলের দিকে শত শত রকেট ও ড্রোন ছুঁড়েছে।

তারপর থেকে দুই দেশ একে অপরের ওপর দফায় দফায় হামলা চালিয়ে যাচ্ছে, এবং আকাশপথে এই হামলা-পাল্টা-হামলার আজ ১০ম দিনেও সংঘাত তাে থামেইনি, বরং এক অনিশ্চিত রূপ নিয়েছে।

ট্রাম্প বহুদিন ধরেই বলে আসছেন যে, তিনি ইরানের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র থাকার বিরোধী।

তবে, ইসরায়েলের কাছে এমন অনেক অস্ত্র আছে বলে অনেক বিশেষজ্ঞের ধারণা, যদিও দেশটি তা স্বীকার বা অস্বীকার কোনটাই করেনি।

গত মার্চ মাসে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্সের পরিচালক তুলসি গ্যাবার্ড বলেছেন, ইরান ইউরেনিয়ামের মজুদ নজিরবিহীন মাত্রায় বাড়ালেও পরমাণু বোমা বানাচ্ছে না।

যদিও ট্রাম্প সম্প্রতি এই মূল্যায়নকে 'ভুল' বলে মন্তব্য করেছেন।

নিজের নির্বাচনী প্রচারণার সময় ট্রাম্প পূর্ববর্তী মার্কিন প্রশাসনগুলোর সমালোচনা করে বলেছিলেন, তারা মধ্যপ্রাচ্যে 'বোকার মতো' 'শেষ হওয়ার নাম নেই এমন যুদ্ধে' জড়িয়েছে।

তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, আমেরিকাকে তিনি বিদেশি কোন সংঘাতে জড়াবেন না।

ইউএস-বি-টু স্পিরিট যুদ্ধবিমানই শুধু জিবিইউ-৫৭এ/বি ম্যাসিভ অর্ডন্যান্স পেনিট্রেটর (এমওপি) বোমা বহন করতে পারেছবির উৎস,US AIR FORCE
ছবির ক্যাপশান,ইউএস-বি-টু স্পিরিট যুদ্ধবিমানই শুধু জিবিইউ-৫৭এ/বি ম্যাসিভ অর্ডন্যান্স পেনিট্রেটর (এমওপি) বোমা বহন করতে পারে
ইসরায়েলের আকস্মিক হামলার সময় যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান পারমাণবিক আলোচনায় ছিলো।

মাত্র দুই দিন আগেই ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি ইরানকে অর্থবহ আলোচনায় বসার জন্য দুই সপ্তাহ সময় দেবেন, তারপরই হামলা করবেন।

কিন্তু বাস্তবে সেই সময়সীমা তার চেয়ে অনেক ছোট হয়ে এসেছে।

যুক্তরাষ্ট্র কোথায় বোমা ফেলেছে, আর কী ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করেছে?
যুক্তরাষ্ট্র বলছে, তারা ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় আঘাত করেছে। সেগুলো হলো - ফোর্দো, নাতাঞ্জ এবং ইসফাহান।

ফোর্দো হল ইরানে পাহাড়ের ভেতরে লুকানো স্থাপনা, যা তেহরানের দক্ষিণে অবস্থিত। ধারণা করা হয়, এর অবস্থান ভূপৃষ্ঠ থেকে এত গভীরে যে এটি যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সকে যুক্ত করা চ্যানেল টানেলের চেয়েও নিচে।

ফোর্দোর এই পারমানবিক স্থাপনা ভূপৃষ্ঠ থেকে এত গভীরে থাকার কারণে ইসরায়েলের অস্ত্র দিয়ে এটি ধ্বংস করা কঠিন হয়ে পড়েছে।

কেবল যুক্তরাষ্ট্রের কাছে 'বাংকার বাস্টার' নামে এমন একটি বড় ও শক্তিশালী বোমা আছে যা ফোর্দো ধ্বংস করতে পারে।

এই মার্কিন বোমার নাম জিবিইউ-৫৭ ম্যাসিভ অর্ডন্যান্স পেনিট্রেটর (এমওপি - এর ওজন ১৩ হাজার কেজি , এবং এটি বিস্ফোরণের আগে প্রায় ১৮ মিটার কংক্রিট বা ৬১ মিটার মাটি ভেদ করতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন।

ফোর্দোর টানেলগুলো মাটি থেকে প্রায় ৮০ থেকে ৯০ মিটার গভীরে বলে ধারণা করা হয়, তাই এমওপি সফল হবে এমন নিশ্চয়তা নেই।

তবে এটিই একমাত্র বোমা যা এতটা গভীরে পৌঁছাতে পারে।

মার্কিন কর্মকর্তারা সিবিএস-কে নিশ্চিত করেছেন, এই হামলায় এমওপি ব্যবহার করা হয়েছে, এবং প্রতিটি লক্ষ্যবস্তুর জন্য দুটি করে বোমা ফেলা হয়েছে।

গ্রাফিক্স
ইরানে কী প্রভাব পড়েছে?
যুক্তরাষ্ট্রের এই হামলায় পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে বা কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেছে কী না – তা এখনও স্পষ্ট নয়।

ইরানের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যমের উপ-রাজনৈতিক পরিচালক হাসান আবেদিনি বলেছেন, ইরান কিছু দিন আগেই এই তিনটি পারমাণবিক স্থাপনা খালি করে ফেলেছিল।

রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে তিনি বলেন, "ইরান বড় কোনো ক্ষতির শিকার হয়নি, কারণ সেগুলোতে থাকা উপকরণ আগেই সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল।"

টেলিভিশনে দেওয়া ভাষণে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, "পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ স্থাপনাগুলো পুরোপুরি ও সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে।"

কিন্তু বিবিসি নিউজ চ্যানেলে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাজনীতি ও সামরিক বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্ক কিমিট বলেন, "চিরতরে ধ্বংস হয়েছে, এমনটা বলার সুযোগ নেই।"

ইরান জানিয়েছে, ইসরায়েলের সঙ্গে সাম্প্রতিক সংঘর্ষে ২০০ জনের বেশি নিহত এবং ১,২০০ জনের বেশি আহত হয়েছেন।

এদিকে, মার্কিন হামলার পর ইসরায়েল তার নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করেছে।

গ্রাফিক্স
ইসরায়েল সারাদেশে জননিরাপত্তা বিধিনিষেধ কঠোর করেছে বলে জানিয়েছে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)।

নতুন বিধিনিষেধের মধ্যে "শিক্ষা কার্যক্রম, জমায়েত এবং কর্মস্থলে যাওয়া" নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, যা ইরানে মার্কিন হামলার পরপরই কার্যকর হয়েছে।

ইরান কীভাবে পাল্টা জবাব দিতে পারে?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইসরায়েল এরই মধ্যে ইরানের সামরিক ঘাঁটিগুলোয় আঘাত হেনে তাদের যথেষ্ট দুর্বল করে ফেলেছে।

এবং ইরানের আঞ্চলিক মিত্র যেমন লেবাননের হেজবুল্লাহ সেইসাথে সিরিয়ায় এবং গাজায় হামাসকে অনেকটাই দুর্বল করে দিয়েছে।

তবুও ইরান এখনো বড় ধরনের ক্ষতি করার সক্ষমতা রাখে।

ইরানি কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্রকে এ সংঘাতে না জড়াতে আহ্বান করেছিলো, তারা বলেছিলেন, তাতে 'অশেষ ক্ষতি' হবে এবং এই অঞ্চলে 'পূর্ণ যুদ্ধের' ঝুঁকি তৈরি হবে।

ইরান হুমকি দিয়েছে, তারা মার্কিন ঘাঁটিগুলোকে টার্গেট করবে।

মধ্যপ্রাচ্যে অন্তত ১৯টি অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। যেমন বাহরাইন, মিশর, ইরাক, জর্ডান, কুয়েত, কাতার, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত।

সবচেয়ে স্পষ্ট টার্গেটগুলোর মধ্যে একটি হলো মার্কিন নৌবাহিনীর পঞ্চম বহরের সদর দপ্তর, যেটি বাহরাইনের মিনা সালমানে অবস্থিত।

তারা একটি গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক রুটে আঘাত করতে পারে, যার নাম হরমুজ প্রণালী।

এটি পারস্য উপসাগরকে ভারত মহাসাগরের সঙ্গে যুক্ত করেছে এবং এই পথ দিয়ে বিশ্বের ৩০ শতাংশ তেল পরিবহণ হয়।

ট্রাম্প
তারা অন্যান্য সামুদ্রিক রুটেও হামলা করতে পারে, যা বিশ্ববাজারে অস্থিরতা তৈরি করতে পারে।

ইরান আশেপাশের সেই দেশগুলোরও স্থাপনাকেও টার্গেট করতে পারে, যারা যুক্তরাষ্ট্রকে সাহায্য করছে বলে তারা মনে করে।

এতে যুদ্ধ গোটা অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে।

ট্রাম্প কি কংগ্রেসের অনুমতি ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধে নিতে পারেন?
মার্কিন আইন অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট এককভাবে কোনো দেশে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারেন না।

শুধু কংগ্রেস অর্থাৎ নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদ ও উচ্চকক্ষ সেনেটে নির্বাচিত আইনপ্রণেতারাই, তা করতে পারেন।

তবে আইনে বলা আছে, প্রেসিডেন্ট সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক বা কমান্ডার ইন চিফ।

এর মানে হচ্ছে, তিনি যুদ্ধ ঘোষণা না করেও সেনা মোতায়েন ও সামরিক অভিযান চালাতে পারেন।

উদাহরণস্বরূপ, ২০১৭ সালে ট্রাম্প সিরিয়ায় আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে বিমান হামলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কংগ্রেসের অনুমতি ছাড়াই।

তিনি এককভাবে সিদ্ধান্ত নেন, যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা ও মানবিক কারণ দেখিয়ে।

সম্প্রতি কংগ্রেসের উভয় দলের কয়েকজন আইনপ্রণেতা "ওয়ার পাওয়ার রেজোলিউশন" অর্থাৎ যুদ্ধের সক্ষমতা প্রস্তাব পার্লামেন্টে উত্থাপন করেন, যেন ট্রাম্প ইরানে হামলার নির্দেশ সহজে দিতে না পারেন, ট্রাম্পের হামলা চালানোর ক্ষমতা যেন সীমিত করা যায়।

তবে এই প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে ভোটে গড়াতে কয়েক সপ্তাহ লেগে যেতে পারে, এবং এমন পদক্ষেপগুলো বাস্তব প্রভাবের চেয়ে প্রতীকী বলেই বেশি মনে করা হয়।

সম্পাদকীয় :

Publisher & Editor :Md. Abu Hena Mostafa Zaman

Mobile No: 01971- 007766; 01711-954647

রাজশাহীর সময় অনলাইন নিউজ পোর্টাল আবেদনকৃত চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর, ঢাকা ।

অফিস :

Head office: 152- Aktroy more ( kazla)-6204 Thana : Motihar,Rajshahi

Email : [email protected],                    [email protected]