বন্ধুর বিপদে হাজির ড্রাগন! ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে পাকিস্তানের মনোবল বাড়াচ্ছে চিন


আন্তর্জাতিক ডেস্ক: , আপডেট করা হয়েছে : 30-04-2025

বন্ধুর বিপদে হাজির ড্রাগন!  ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে পাকিস্তানের মনোবল বাড়াচ্ছে চিন

পহেলগাঁও কাণ্ডকে কেন্দ্র করে ভারত-পাক উত্তেজনার আবহে খবরের শিরোনামে চিন। এই পরিস্থিতিতে ইসলামাবাদের হাত শক্ত করতে হাতিয়ার সরবরাহ করছে বেজিং। ড্রাগনভূমি থেকে অত্যাধুনিক পিএল-১৫ আকাশ থেকে আকাশ (এয়ার টু এয়ার) ক্ষেপণাস্ত্র হাতে পেয়েছে পাক বিমানবাহিনী। এতে নয়াদিল্লির রক্তচাপ বাড়ল বলেই মনে করছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা।

কাশ্মীরে পর্যটকদের গণহত্যার পর ভারত যে বদলা নেওয়ার সুযোগ খুঁজছে, তা হাড়ে হাড়ে বুঝেছে পাকিস্তান। এই পরিস্থিতিতে চিনা পিএল-১৫ ক্ষেপণাস্ত্র হাতে পাওয়ায় ‘শক্তি প্রদর্শন’-এর সুযোগ ছাড়েনি ইসলামাবাদ। পাক বায়ুসেনার বহরে রয়েছে বেজিঙের তৈরি জেএফ-১৭ যুদ্ধবিমান। সেই লড়াকু জেটগুলির ছবি প্রকাশ করে নয়াদিল্লিকে ‘ভয়’ দেখানোর নিষ্ফল চেষ্টা চালিয়েছেন রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তারা। 

গত ২৭ এপ্রিল তিনটি জেএফ ১৭ যুদ্ধবিমানের ছবি সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয় পাক বিমানবাহিনী। সংশ্লিষ্ট লড়াকু জেটগুলি পিএল-১৫ ক্ষেপণাস্ত্রে সজ্জিত ছিল। উল্লেখ্য, দৃষ্টিশক্তির বাইরে (বিয়ন্ড ভিস্যুয়াল রেঞ্জ) হামলা চালানোর ক্ষমতা রয়েছে এই মারণাস্ত্রের। ফলে মাঝ-আকাশের ডগফাইটে চিনা পিএল-১৫ ভারতীয় বিমানবাহিনীর মাথাব্যথার কারণ হতে পারে, বলছেন সাবেক সেনাকর্তারা।

প্রতিরক্ষা সংবাদমাধ্যম ক্ল্যাশরিপোর্টের প্রতিবেদনকে উদ্ধৃত করে দ্য ইউরেশিয়ান টাইমস জানিয়েছে, ‘পিপল্‌স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ বায়ুসেনার অস্ত্রাগার থেকে সংশ্লিষ্ট ক্ষেপণাস্ত্রগুলিকে ইসলামাবাদের হাতে তুলে দিয়েছে বেজিং। শুধু তা-ই নয়, পরমাণু শক্তিধর দুই প্রতিবেশী সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে, এই ধরনের আরও হাতিয়ার পাক ফৌজকে সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ড্রাগন সরকার।

বেজিঙের সরকারি সংস্থা ‘অ্যাভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রি কর্পোরেশন অফ চায়না’র তৈরি পিএল-১৫কে এককথায় দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র বলা যেতে পারে। রাডার নিয়ন্ত্রিত সক্রিয় হাতিয়ার এটি। ক্ষেপণাস্ত্রটির পাল্লা ২০০ থেকে ৩০০ কিলোমিটার। শব্দের পাঁচ গুণের চেয়ে বেশি (পড়ুন ফাইভ ম্যাক প্লাস) গতিতে ছোটার ক্ষমতা রয়েছে এই হাতিয়ারের।

গত বছরের নভেম্বরে ঝুহাই এয়ারশোয়ে ভাঁজ করা পাখনা যুক্ত পিএল-১৫ ক্ষেপণাস্ত্রটি প্রদর্শন করে পিএলএ বিমানবাহিনী। এর রফতানি উপরূপটির পাল্লা ১৪৫ কিলোমিটার বলে জানা গিয়েছে। কিন্তু সূত্রের খবর, পাক বায়ুসেনার প্রকাশ করা ছবিতে যে ক্ষেপণাস্ত্রগুলি দেখা গিয়েছে সেগুলির পাল্লা আরও বেশি। সংঘাতের আবহে চিন যে গোপনে ইসলামাবাদকে সাহায্য করে চলেছে এই ঘটনাই তার প্রমাণ, বলছেন সাবেক ফৌজি অফিসারেরা।

২০১৮ সাল থেকে পিএল-১৫ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করছে ড্রাগনের বায়ুসেনা। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশ ইউরোপের মিটিওর ক্ষেপণাস্ত্রের সঙ্গে এর তুলনা টেনে থাকেন। ভারতীয় বিমানবাহিনীর বহরে রয়েছে ফরাসি সংস্থা দাসোঁ অ্যাভিয়েশনের তৈরি রাফাল যুদ্ধবিমান। এই লড়াকু জেটের অন্যতম অস্ত্র হল মিটিওর। ফলে আকাশ-যুদ্ধে পাক বায়ুসেনাকে যে এ দেশের পাইলটেরা এক ইঞ্চিও জমি ছেড়ে দেবেন না, তা বলাই বাহুল্য।

ইংরেজিতে মিটিওর শব্দটির অর্থ হল উল্কা। নামের সঙ্গে এই ক্ষেপণাস্ত্রের গতি ও ধ্বংসক্ষমতার বেশ মিল রয়েছে। রাফাল লড়াকু জেটগুলির মিটিওরের পাল্লা ১০০ থেকে ২০০ কিলোমিটার। শব্দের চার গুণের বেশি গতিতে (পড়ুন ফোর ম্যাক প্লাস) ছুটতে পারে এই ক্ষেপণাস্ত্র। পিএল-১৫-এর মতো এই হাতিয়ারটিরও ‘বিয়ন্ড ভিস্যুয়াল রেঞ্জ’ হামলা করার সক্ষমতা রয়েছে। ফ্রান্স ছাড়াও ব্রিটেন, জার্মানি, ইটালি, স্পেন এবং সুইডেনে বহুল পরিমাণে তৈরি হয় এই ক্ষেপণাস্ত্র।

গতির নিরিখে চিনা ক্ষেপণাস্ত্রটি এগিয়ে থাকলেও মিটিওরকে দরাজ সার্টিফিকেট দিয়েছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা। তাঁদের একাংশের দাবি, মুখোমুখি লড়াইয়ে রাফালের হাতিয়ারটির সঙ্গে এঁটে ওঠা মুশকিল। তার মূল কারণ মিটিওরে রয়েছে র‌্যামজেট ইঞ্জিন। ফলে লড়াকু জেট থেকে ছোড়ার পর সুনির্দিষ্ট উচ্চতায় সমান গতি ধরে রেখে নিখুঁত নিশানায় লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালাতে পারে এই ক্ষেপণাস্ত্র।

চিনের তৈরি পিএল-১৫-এর সবচেয়ে বড় সমস্যা হল, এগুলি ছোড়ার পর খুব অল্প সময়ের জন্যেই গতি ধরে রাখতে পারে। দ্বিতীয়ত, মিটিওর দিয়ে হামলা করে লক্ষ্যবস্তু সরে গিয়েছে বুঝলে ফের নিশানা ঠিক করে সে দিকে ক্ষেপণাস্ত্রটিকে পাঠানোর সুবিধা পেয়ে থাকেন যোদ্ধা পাইলট। রাফালে বসেই একে ট্র্যাক করতে পারেন তাঁরা। এই সক্ষমতার জন্য পিএল-১৫র চেয়ে বেশ কিছুটা এগিয়ে রয়েছে মিটিওর।

দ্য ইউরেশিয়ান টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, পাকিস্তানের সঙ্গে পুরো মাত্রায় যুদ্ধ বাধলে শুধুমাত্র মিটিওরের উপরে ভরসা করবে না ভারতীয় বিমানবাহিনী। সে ক্ষেত্রে রাশিয়া থেকে আর-৩৭ এম ক্ষেপণাস্ত্র আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে নয়াদিল্লির। গত তিন বছর ধরে চলে আসা ইউক্রেন যুদ্ধে এই হাতিয়ারটির বহুল ব্যবহার করেছে মস্কো। কিভের এফ-১৬র মতো অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান ধ্বংস করতে এর উপরে নির্ভরশীল ছিলেন রুশ যোদ্ধা পাইলটেরা।

প্রতিরক্ষা সংস্থা লকহিড মার্টিনের তৈরি এফ-১৬ যুদ্ধবিমানকে পাক বায়ুসেনার শিরদাঁড়া বলে মনে করা হয়। ভারত মস্কো থেকে আর-৩৭ এম ক্ষেপণাস্ত্র আমদানি করলে ইসলামাবাদের যে বিপদ বাড়বে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এ দেশের বিমানবাহিনীর সাবেক পাইলট বিজ়েন্দর কে ঠাকুর বলেছেন, ‘‘এ দেশের মাটিতেই আর-৩৭ এম তৈরির আগ্রহ প্রকাশ করেছে রাশিয়া। সরকারের এ ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করা উচিত।’’

ভারতীয় বিমানবাহিনীর বহরে রয়েছে ২৬০টির কাছাকাছি রাশিয়ার তৈরি এসইউ-৩০এমকেআই লড়াকু জেট। এই যুদ্ধবিমানগুলির আর-৭৭ ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার সক্ষমতা রয়েছে। এয়ার টু এয়ার এই হাতিয়ারের পাল্লাও ১০০ থেকে ২০০ কিলোমিটার। এ ছাড়া মস্কোর সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে তৈরি ‘ব্রহ্মোস’ সুপারসনিক ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলার ক্ষেত্রেও এস-ইউ৩০ এমকেআই যুদ্ধবিমানের উপর নির্ভরশীল এ দেশের বিমানবাহিনী।

এ ছাড়া দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি তেজস যুদ্ধবিমানে প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ডিআরডিওর অস্ত্র ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে ভারতীয় বায়ুসেনা। ১৯০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তু ওড়াতে এর জুড়ি মেলা ভার। বায়ুসেনার প্রাক্তন গ্রুপ ক্যাপ্টেন অজয় আহলত বলেছেন, ‘‘এটা মনে রাখতে হবে যে আমাদের হাতে একাধিক বিকল্প রয়েছে। লড়াইয়ের ময়দানে সেগুলি মোড় ঘোরাতে পারে।’’ হালকা লড়াকু জেট তেজসকে আরও শক্তিশালী করতে অস্ত্র ক্ষেপণাস্ত্রের সংখ্যা বৃদ্ধির দাবি তুলেছেন তিনি।

পহেলগাঁও জঙ্গি হামলার পর বদলা নিতে লাগাতার মহড়া চালাচ্ছে ভারতীয় বিমানবাহিনী। এই যুদ্ধাভ্যাসের পোশাকি নাম ‘অপারেশন আক্রমণ’ রাখা হয়েছে। সূত্রের খবর, মধ্য ভারতের একাধিক ঘাঁটিতে এই মহড়া চলছে বলে জানা গিয়েছে। অম্বালা ও হাসিমারা ছাউনি থেকে একাধিক রাফালকে সেখানে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে খবর পাওয়া গিয়েছে।

পাশাপাশি, সংঘাতের আবহে ২৬টি ‘রাফাল মেরিন’ (রাফাল-এম) যুদ্ধবিমান কেনার ব্যাপারে ফ্রান্সের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি করল মোদী সরকার। ৬৩ হাজার কোটি টাকার এই চুক্তি অনুযায়ী, ২০৩১ সালের মধ্যে রাফালের ২২টি এক আসনের নৌ-সংস্করণ এবং চারটি দুই আসনের প্রশিক্ষণ লড়াকু জেট সরবরাহ করবে ফরাসি সংস্থা দাসোঁ অ্যাভিয়েশন।

পহেলগাঁও কাণ্ডের পর পাকিস্তানের সঙ্গে ৬৫ বছরের পুরনো সিন্ধু জলচুক্তি স্থগিত করেছে মোদী সরকার। বিশ্লেষকদের একাংশ একে ‘ওয়াটার স্ট্রাইক’ হিসাবে উল্লেখ করেছেন। অন্য দিকে, এই ইস্যুতে সুর চড়িয়েছে ইসলামাবাদ। নদীর জল বন্ধ হলে তাকে যুদ্ধ হিসাবে দেখা হবে বলে হুমকির সুর শোনা গিয়েছে শাহবাজ় শরিফ সরকারের গলায়। পাক রেলমন্ত্রী আবার এক ধাপ এগিয়ে পরমাণু হামলার হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন।

পাশাপাশি, পহেলগাঁও হামলা নিয়ে নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি তুলেছে ইসলামাবাদ। পাক প্রতিরক্ষামন্ত্রী খোয়াজা আসিফ বলেছেন, ‘‘কোনও প্রমাণ ছাড়া আমাদের ইচ্ছাকৃত ভাবে দায়ী করা হচ্ছে। রাশিয়া, চিন বা অন্য কোনও পশ্চিমা দেশ এর তদন্ত করে দেখতে পারে।’’ বিশ্লেষকদের দাবি, কূটনৈতিক ভাবে ভারতকে চাপে ফেলতে ওই মন্তব্য করেছেন তিনি।

পাকিস্তানের এই নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবিকে সমর্থন করেছে চিন। বেজিঙের সরকারি সংবাদ সংস্থা গ্লোবাল টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গোটা ঘটনার উপর নজর রাখছে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিঙের সরকার। পাক বিদেশমন্ত্রী তথা উপপ্রধানমন্ত্রী ইসাক দারের সঙ্গে ড্রাগনের বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ই-র ফোনে কথা হয়েছে বলে জানা গিয়েছে।

এই আবহে আবার সন্ত্রাস-বিরোধী বার্তা দিয়েছে আমেরিকা। মার্কিন বিদেশ দফতরের মুখপাত্র সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, ভারত এবং পাকিস্তানের কূটনৈতিক সম্পর্কের টানাপড়েনের দিকে নজর রাখছে ওয়াশিংটন। যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ভারতের পাশে আছে। একই রকমের প্রতিক্রিয়া দিয়েছে রাশিয়া-সহ ইউরোপের একাধিক দেশ।


Publisher & Editor :Md. Abu Hena Mostafa Zaman

Mobile No: 01971- 007766; 01711-954647

Head office: 152- Aktroy more ( kazla)-6204  Thana : Motihar,Rajshahi
Email : [email protected], [email protected]